মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গ সম্মেলনের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক ঘটনা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৪:৩১ পিএম, ৭ জুলাই ২০২৩ শুক্রবার

সাত লাখ ডলার দিয়ে এনএবিসিকে
বাঁচালেন কালী প্রদীপ চৌধুরী


 
   
   
আজকাল রিপোর্ট -
চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় বাঙালি উৎসব বঙ্গ সম্মেলন। তবে শত অতৃপ্তির মাঝেও শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে ভারত ও কিছু সংখ্যক বাংলাদেশের শিল্পীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশনা। দুই বাংলার পাঁচ হাজারেরও বেশি বাঙালির উপস্থিতিও অনুষ্ঠানকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। অনুষ্ঠানটি মূলত ভারতীয় বাঙালিদের বার্ষিক আয়োজন হলেও কয়েক বছর ধরে এতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অংশগ্রহণ করছেন।
বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজক সংগঠকদের অপেশাদারী মনোভাবের কারণে শিল্পী, কলাকুশলী, অংশগ্রহণকারী সবাই ছিলেন ক্ষুব্ধ। নতুন এ সংগঠনটির অনুষ্ঠান আয়োজনে অনভিজ্ঞতা, সর্বোপরি সম্মেলনের আহ্বায়ক পার্থসারথী মুখোপাধ্যায়ের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বঙ্গ সম্মেলনের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। হোটেল, খাবার, অনুষ্ঠান আয়োজনসহ সবকিছুতেই ছিল চরম অব্যবস্থাপনা। আর এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন সম্মেলনে আগত পাঁচ হাজার অংশগ্রহণকারী।
এবারের বঙ্গ সম্মেলনে ভারতীয় বাঙালিদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। তাদের যৌথ পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শকদের।
পঞ্চাশ বছরের পুরনো সংগঠন বঙ্গ সংস্কৃতি সংঘ বা কালচারাল এসোসিয়েশন অব বেঙ্গল-সিএবি’র সিস্টার কনসার্ন নর্থ আমেরিকা বেঙ্গলি কনফারেন্স-এনএবিসি বা বঙ্গ সম্মেলন। গত বছর লাস ভেগাস বঙ্গ সম্মেলনে সিএবি ২০২৩ সালের জন্য তাদের ব্র্যান্ড এনএবিসি’র পতাকা তুলে দেয় অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন কেপিসি (কালী প্রদীপ চৌধুরী) বেঙ্গলি হল অব ফেম-এর হাতে। এই সংগঠনটির আয়োজনে গত ৩০ জুন এবং ১ ও ২ জুলাই নিউ জার্সীর আটলান্টিক সিটির মর্যাদাপূর্ণ সুবিশাল ভেন্যু জিম হোয়েলান বোর্ডওয়াক হলে অনুষ্ঠিত হয় ৪৩তম বঙ্গ সম্মেলন।
সিএবি’র একটি সূত্র বলছে, এবারের বঙ্গ সম্মেলনটি হওয়ার কথা ছিল বোস্টনে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বোস্টনের সংগঠনটি অপরাগতা জানালে তাড়াহুড়ো করে নিউজার্সীতে বঙ্গ সম্মেলন করার জন্য স্থানীয় নতুন সংগঠন কেপিসি বেঙ্গলি হল অব ফেমকে দেওয়া হয়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সিএবি’র একজন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য জানান, তিনদিন আগে এবারের বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজকরা জানান, তাদের ঘাটতি নয় লাখ ডলার। এ অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হবে না। বঙ্গ সম্মেলন বাতিল হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ সিএবি’র সিনিয়র সদস্যরা কালী প্রদীপ চৌধুরীকে বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি সাত লাখ ডলার ব্যবস্থা করলে বঙ্গ সম্মেলন বেঁচে যায়।
অপর এক সদস্য বলেন, বঙ্গ সম্মেলন আয়োজনের পুরো দায়িত্ব থাকে হোস্ট সংগঠনের। সিএবি সাধারণত কোনো খবরদারি করে না। বেঙ্গলি হল অব ফেম প্রতিষ্ঠানটি কালী প্রদীপ চৌধুরীর কেপিসি গ্রুপের স্পন্সরে হলেও তিনি এর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি বিশেষের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে যেমন ঠকেছেন তেমনি তাঁর অর্থও অপচয় হয়েছে।
কালী প্রদীপ চৌধুরীর কাছ থেকে সাত লাখ ডলার পাওয়ার পর বঙ্গ সম্মেলনের কোর কমিটির কাছ থেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নেয় সিএবি। তারা যথাসাধ্য চেষ্টায় বঙ্গ সম্মেলনকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিএবি সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। জানা যায়, অর্থের অভাবে বঙ্গ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মূল ভেন্যুতে না করে এগার মাইল দূরে একটি হোটেলে করা হয়। সেখানে সিএবি’র বর্তমান প্রেসিডেন্ট রণদেব সরকারকে বক্তব্য রাখার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এমনকি রীতি অনুযায়ী সিএবি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানটিও বাতিল করে দেওয়া হয়। আর এসব কিছুই হয়েছে বঙ্গ সম্মেলনের এবারের আহ্বায়ক পার্থসারথী মুখোপাধ্যায়ের একক সিদ্ধান্তে।
অবস্থা বেগতিক দেখে পার্থসারথী মুখোপাধ্যায়ের সাথে স্টিয়ারিং কমিটিতে যারা ছিলেন তারাও একে একে সটকে পড়তে থাকেন। শেষ পর্যন্ত পার্থ মুখার্জির পাশে তাঁর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।    
বঙ্গ সম্মেলনের ইতিহাসে এতটা বিশৃঙ্খলা কখনও হয়নি। অনুষ্ঠানে আগত হাজার পাঁচেক অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই সময়মতো হোটেল পাননি। পুরো আয়োজনে কোথায় কি হচ্ছে তা জানার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নাম মাত্র অনুষ্ঠানসূচি থাকলেও তা প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হয়েছে।
এত অব্যবস্থাপনার মধ্যেও তিনদিনের মহাযজ্ঞে পারফর্ম করেন দুই বাংলার শতাধিক শিল্পী। ছিল পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর, পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের সরোদ বাদন, রাগব চ্যাটার্জি ও জয়তী চক্রবর্তীর একক এবং ক্যাকটাস ব্যান্ডের পরিবেশনা, সর্বোপরি বলিউড সংগীত তারকা সনু নিগম ও জাভেদ আলীর পৃথক কনসার্ট। বাংলাদেশের দুই শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের পরিবেশনাও মুগ্ধ করে কয়েক হাজার দর্শককে। স্থানীয় কিছু সংগঠনের পরিবেশনাও ছিল আকর্ষনীয়। তবে কোনো কিছুই সময়মতো না হওয়ায় সবাই ছিলেন বিক্ষুব্ধ। ভারতীয় শিল্পীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে একে লাইভে এসে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছেন। তারা কলকাতায় প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছেন। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যা সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ইতোমধ্যে নিউজার্সী অ্যাটর্নি অফিসে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। সংক্ষুব্ধ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক পার্থসারথী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বঙ্গ সম্মেলনের সাহিত্য আসরটি ছিল বেশ জমজমাট। এর প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরীন। এতে ভারতীয় সাহিত্যিক কুনাল বসু, সুবোধ সরকার, মৌসুমী সেন, রুদ্রশংকর, আমেরিকার সাহিত্যিক ক্যালোলিন রাইট ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক অংশ নেন।
ভারতের বাংলা চলচ্চিত্র তারকাদের মধ্যে ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, পায়েল সরকার, সোহিনী সরকার, অনির্বাণ চক্রবর্তী, দেবশংকর হালদার, পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় ও রেশমী মিত্র। বঙ্গ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ইন্দো-ইটালিয়ান চলচ্চিত্র উৎসব। এতে ইতালির তারকা অভিনয় শিল্পী ও পরিচালকরা অংশ নেন।
উল্লেখ্য, এবছর বঙ্গ সম্মেলনের সাধারণ রেজিস্ট্রেশন ছিল পরিবার (শিশুসহ চারজন) প্রতি ৩৮০ ডলার। হোটেলের জন্য ব্যয় করতে হয়েছে গড়ে প্রতিরাতে ২৫০ ডলার। পুরো আয়োজনের বাজেট ১.৫ মিলিয়র ডলার থাকলেও শেষমেষ তা ২ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।