নিউইয়র্কে এখন চোরের উপদ্রুব
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:৩৭ পিএম, ৭ জুলাই ২০২৩ শুক্রবার
দোকানের শেলফে সারি সারি তালা
সারি সারি ঝুলছে তালা। তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে কাচের পাল্লা দেয়া শেলফে থরে থরে সাজানো পণ্যসামগ্রী। কি এমন পণ্য এ সব? তেমন মূল্যবান কিছু নয়, সোনা-চাঁদি বা চোখ ধাঁধাঁনো অলঙ্কারসম্ভার নয়, এগুলি নেহাতই স্বল্প মূল্যের নিত্য সামগ্রী। যেগুলির কোনটারই দাম ২ থেকে ৮ ডলারের বেশি নয়। মূলত খাদ্যদ্রব্য। ডিম, দুধ, পুষ্টিকর পানীয়, নানা ধরনের চিজ, গরম করে খাওয়ার জন্য প্যাকেটবদ্ধ পিজা, চিজ দিয়ে তৈরি নানা ধরনের খাদ্যবস্তু, এই সব।
এগুলিকেই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে প্রসিদ্ধ চেন স্টোরের র্যাকে কাচের পাল্লার ভেতরে। না, শুধু এগুলিই নয়, পুরো স্টোরের প্রশস্ত পরিসরে আরো অনেক শেলফই এখন তালাবদ্ধ, যেগুলির ভেতরে রয়েছে প্রসাধনীসামগ্রী, ওষুধপত্র, এয়ার ফ্রেশনার, অন্যান্য স্প্রে জাতীয় দ্রব্য এমনকি টুথপেস্ট-টুথব্রাশও। দোকানটির এসব সামগ্রী এখন ক্রেতাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সবই শেলফে তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা। প্রচলিত অভ্যাস অনুযায়ী কোন জিনিষ নেড়েচেড়ে দেখেশুনে কেনার যে নিয়মে ক্রেতারা অভ্যস্ত তাতে এখন বড় ধরনের ছেদ পড়ে যাচ্ছে। এখন আর কোন জিনিসই হাতে নিয়ে দেখেশুনে-নেড়েচেড়ে পছন্দ করে কেনার সুযোগ থাকছে না। কোন পণ্য কিনতে তার গায়ে লেখা পণ্যটির তথ্যাবলী পড়ে দেখারও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন এই তালা-চাবির ব্যবস্থা? কর্তৃপক্ষের সোজা-সাপটা জবাব চোরের ভয়ে। চোরের উৎপাতে তারা দোকানের পণ্যসামগ্রীকে তালাবদ্ধ করে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। খোলা শেলফে রাখা জিনিস অহরহ চুরি হয়ে যাচ্ছে। এই চুরি সামাল দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। প্রথম প্রথম প্রসাধনী সামগ্রী, চট করে পকেটে ঢুকানো যায় এমন সব ওষুধপত্র ও অন্যান্য ছোটখাট মূল্যবান জিনিস খোয়া যেত। কিন্তু এই চুরির দৌরাত্ম্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এখন শুধু আর মূল্যবান সামগ্রী নয়, হাতের কাছে যা খোলা পাচ্ছে চোরেরা তাই নিয়ে চলে যাচ্ছে।
দোকানের দ্রব্য চুরি, যাকে বলা হয় ‘শপ লিফটিং’, পৃথিবী জুড়েই এক পরিচিত ঘটনা। দীর্ঘ দিন ধরেই এসব ঘটে আসছে। এক শ্রেণীর মানুষের এ এক ধরনের ব্যাধি, এক বিকৃত প্রবণতা। দেশে দেশে ঘটে চলেছে শপ লিফটিং-এর দৌরাত্ম্য। এ প্রবণতা শুধু পেশাদার চোর কিংবা অভাবগ্রস্ত মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অনেক শিক্ষিত রুচিবান সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিকেও এই প্রবণতায় আক্রান্ত হবার কথা শোনা যায়। মনস্তত্ব বিজ্ঞানের ভাষায় এ এক ধরনের অসুস্থতা। এক ধরনের মানসিক বৈকল্য। এ ধরনের প্রবণতার মানুষদের বলা হয় ‘ক্লেপটোম্যানিয়াক’। এই প্রবণতায় আক্রান্ত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও শপ লিফটিং করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মানুষদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিক, অভিনয় শিল্পী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও।
শপ লিফটিং বন্ধে কোথায় কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে তথ্য হাতের কাছে নেই। তবে নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটসের অন্তত একটি চেন স্টোরকে দেখা যাচ্ছে তালা-চাবির শরণাপন্ন হতে। এমন ব্যবস্থা বলা যায় নজিরবিহীন। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কল্পনাও করা যেত না। জ্যাকসন হাইটসের এই দোকানটি বেশ কিছু দিন থেকেই এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে। চুরি বন্ধ করতে না পেরে নেহায়েত নিরুপায় হয়েই তাদের এই উদ্যোগ গ্রহণ। একটি একটি করে শেলফ বন্ধ হতে হতে এখন দোকানটির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ শেলফই তালাবন্ধ। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে স্টোরে তালার সংখ্যা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, চুরি বন্ধ করতে গিয়ে তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তার দায় তো সব শ্রেণীর ক্রেতার ওপরেই পড়ছে। তারা তো তাদের গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে সব ক্রেতার প্রতিই তাদের অবিশ্বাস প্রকাশ করে দিচ্ছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন, ক্রেতাদেরকে তারা বিশ্বাস করেন না, সে তারা যতই নিরীহ হোন না কেন। সাধারণ ক্রেতাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটা অবমাননাকর।
শেলফে তালা যত বাড়ছে বস্তুত ক্রেতাসাধারণের ভোগান্তিও ততই বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ তো তালা ঝুলিয়ে সম্পদ রক্ষা করলেন, কিন্তু সেই তালা খোলার উপায় কি? তালাবদ্ধ দ্রব্যসামগ্রী কেমন করে ক্রেতাদের হাতের নাগালে আসবে? সে উপায় অবশ্যই করা হয়েছে। কিন্তু তালা খোলার পন্থাটি ক্রেতাদের জন্য মোটেই সুখকর নয়। এ ব্যবস্থায় কেউ খুশি নন। ব্যবস্থাটি যেমন বিড়ম্বনার তেমনি সময়সাপেক্ষ। দোকানে কর্মরত স্টাফদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে হবে কোন শেলফের কোন জিনিসটা ক্রেতা কিনতে চান। তালা খুলে দেয়ার জন্য স্টাফদের সাহায্য লাভের আশায় অনেকটা সময় অপেক্ষা করে থাকতে হয়। তারা হাতের কাজ রেখে এসে তালা খুলে সেই নির্দিষ্ট জিনিসটিই শুধু বের করে দেন। অন্য কোন জিনিষ আর দেখা-চাখার সুযোগ ক্রেতাদের হয় না। সেই জিনিসটি বের করে দিয়েই আবার তালা। দোকান জুড়ে ঝুলছে এখন সারি সারি তালা।