‘গতর নেবে গো গতর’
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:৪৭ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২৩ শনিবার
সুনাগরিক -
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূতের বেগার’ যারা পড়েছেন তাদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই ‘গতর নেবে গো গতর’ লেখাটির কথা। কার্ল মার্কসের ‘মজুরি ও পুঁজি’ (ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল) অবলম্বনে অর্থনীতির কথাগুলি সহজ বাংলায় লেখার প্রয়াস সুভাষ মুখোপাধ্যয়ের এই বইটি। তিনি লিখেছেন শ্রম আর খাঁটুনি বা শরীরের পরিশ্রমের মধ্যকার পার্থক্যের কথা। তিনি লিখেছেন শ্রমজীবী মানুষ আসলে শ্রম বিক্রি করে না, বিক্রি করে তার পরিশ্রম, বিক্রি করে তার খাঁটুনি বা তার গতর। এমন গতর খাটা মানুষ তো বিশ্বময়। সব দেশের শ্রমজীবী মানুষই তো গতর খাটে।
বাংলাদেশে, ঢাকা শহরেই, সাত সকালে গতর খাটা মানুষের ভীড় জমে যায় শহর জুড়ে বিভিন্ন স্থানে। নিউমার্কেটের সামনে, গুলিস্তানে, নবাবপুর, সদরঘাট সহ নানা এলাকায় এই গতর খাটা মানুষেরা গিয়ে বসে থাকে কাজের সন্ধানে। বিভিন্ন ধরনের কাজের ধারা তাদের। কেউ দিনমজুর, কেউ যোগালি, কেউ কাঠমিস্ত্রী, কেউ রাজমিস্ত্রী। ভীড় থাকে রং মিস্ত্রীর, স্যানিটারি মিস্ত্রীর। আর থাকে ভারি ভারি কাজের, ভারি ভারি বোঝা টানার মুটে-মজুর। কেউ বসে থাকে ঝুড়ি-কোদাল- কুড়াল হাতে, কারো হাতে হাতুড়ি-বাটাল, অন্যান্য যন্ত্রপাতি। মুটে-মজুরদের থাকে খালি হাত। এদের সাহায্য প্রয়োজন হয় অনেক মানুষের। বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য মানুষ লোকের সন্ধানে এই সব স্থানে আসেন এবং দরদাম করে এক বা একাধিক লোককে নিয়ে যান তাদের নির্দিষ্ট কাজ করাতে।
এমন দৃশ্য এই ধনাঢ্য দেশের বিলাসবহুল নগরী নিউইয়র্কের সর্বদা চোখে পড়ে। চোখে পড়ে কাজের সন্ধানে রাস্তার ধারে বসে থাকা গতর খাটা মানুষদের ভীড়। কত রকমের কাজ এরা করে। বড় বড় ভারি কাজ থেকে বাড়িঘরের নানা কাজ। বাড়ি বদলের যে কাজটি মুভাররা করে সে কাজে তারা নিয়োজিত করে এইসব গতরখাটা মজুরদের। বাড়ির ভারি ভারি মালপত্র, আসবাব সব এরা ঘাড়ে করে নিয়ে মুভারের গাড়িতে ওঠায়। আবার নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে সেগুলি তুলে দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে আসে। এই সব মাল-সামাল নিয়ে তাদেরকে উঠতে হয় অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ওপরেও। কোন কোন ক্ষেত্রে এলিভেটর না থাকলে তাদেরকে এগুলি ঘাড়ে করে সিঁড়ি বেয়েও উপরে উঠতে হয়। মুভাররা সাধারণত দু’জন লোক দিয়েই সব কাজ করান। একটা বাড়ির পুরো মালপত্র ‘মুভ’ করতে তাদের করতে হয় অপরিসীম পরিশ্রম।
এ ধরনের কাজ পাওয়ার জন্য তারা সকাল থেকে বসে থাকে রাস্তার ধারে। যাদের লোকের প্রয়োজন তারা গাড়ি করে এসে এদেরকে নিয়ে যান। যারা কাজ পায় তারা খুশি। অনেকেই যারা কাজ পায় না তাদের দিনটি ওখানে বসেই হয়ত কেটে যায়। সঙ্গে আনা খাবার দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নির্বাহ করতে হয়।
নিউইয়র্কের একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের গাড়িতে মাত্র একজন লোককে দিয়ে একটা বড় সোফা সেট পাঠিয়েছিল তাদের এক খদ্দেরের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটির এলিভেটর তখন কাজ করছিল না। মধ্যবয়সী সেই দিনমজুরটি একা সেই বড় সোফা মাথায় তুলে নিয়ে একটু একটু করে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা পর্যন্ত তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আরো দুর্ভোগ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। খদ্দের ভদ্রলোক জানালেন এই সোফা নয়, প্রতিষ্ঠানটি তাকে ভুল ডেলিভারি দিয়েছে। তিনি সেটা নিতে অস্বীকার করেন। ফলে লোকটা আবার সেটা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একটু একটু করে নিচে নেমে যায়। এজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছিলেন, লোকটা দোতলা পর্যন্ত নেমে আর পারছিল না। সিঁড়িতে দীর্ঘ সময় বসে বিশ্রাম নিয়েছিল।
নিউইয়র্কের এই দিনমজুররা অধিকাংশই ল্যাটিনো। অনেকেই ভালভাবে ইংরেজি বলতে পারে না। হয়ত তাদের আমেরিকায় বসবাসের বৈধতাও নেই। এই দুর্বলতাই তাদেরকে বাধ্য করেছে দিনমজুরের কাজ করতে, কাজের সন্ধানে রাস্তার ধারে বসে থাকতে।