বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৪ ১৪৩১   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের পথে হয়রানির মুখোমুখি লাখ লাখ মানুষ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৬ এএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্ট

বিশেষ প্রতিনিধি -
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বিচারিক হয়রানির স্বীকার হচ্ছে। গত ২ সেপ্টেম্বর ‘কোয়েটলি ক্রাশিং অ্যা ডেমোক্র্যাসি : মিলিয়নস অন ট্রায়াল ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত এ রিপোর্টটি নিয়ে তোলপাড় উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান মুজিব মাশাল ও অতুল লোকের তোলা ছবিতে রিপোর্টে একটি বিশেষ নোট দেওয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে দেশটির সরকারের কড়াকড়ি আরোপের মধ্যেও এই রিপোর্টটি তৈরি করার আগে দুইবার বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন তারা।
নিউইয়র্ক টাইসমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে আদালতের জনাকীর্ণ কক্ষগুলোতে বিচারের নামে কায়দা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লাখ লাখ নেতা, সদস্য এবং কর্মীকে প্রায় প্রতিদিন বিচারকের সামনে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগগুলো যেমন সবৈভ মিথ্যা তেমনি প্রমাণগুলো ভূয়া। দেশটি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের লড়াই যখন আসন্ন, ঠিক সেই মুহূর্তে বিরোধীদের অচল করে দেওয়া যে আয়োজন চলছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির হিসেব অনুযায়ী সংগঠনটির ৫০ লাখ কর্মী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় জর্জরিত। সংগঠনটির সক্রিয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা দায়ের করা হয়েছে, একজনের বিরুদ্ধে শত শত মামলাও দায়ের করা হয়েছে এমন সংখ্যাও অনেক।
সম্প্রতি সাইফুল আলম নিরব নামে এক বিরোধী নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার ১০ তলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ৩১৭টি থেকে ৩৯৪টি মামলা রুজু করা হয়েছে। মামলার সংখ্যা এত বেশি যে, তিনি এবং তার আইনজীবীরা নিশ্চিত ননÑঠিক কতোটি মামলা রয়েছে। আদালতের বাইরে আরও এক ডজন সমর্থককে দেখা গেছে যাদের ওপরে রয়েছে প্রায় ৪০০ মামলা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গার্মেন্টস রপ্তানি শিল্পের উপর দৃঢ় ফোকাস বাংলাদেশকে ডলারের স্থির প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। এই শিল্পের কারণে অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই যে দেশকে দুর্ভিক্ষ আর রোগের ঝুড়ি মনে করতো সেই দেশটি মনে হচ্ছিলো কয়েক দশক ধরে চলা অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক হত্যাকান্ড থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সফলতাকে পুঁজি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক একত্রীকরণের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিরোধী নেতা, বিশ্লেষক ও  মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। যার মধ্যে রয়েছে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন আদালতের। কোনো সমস্যায় যাতে না পড়তে হয় তা নিশ্চিতের জন্য এসব জায়গাগুলো তার অনুগতদের দিয়ে ভরে ফেলেছেন। রাষ্ট্রের এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি হাতিয়ার বানিয়ে বসেছেন বিরোধীদের কন্ঠরোধ করতে এবং রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত প্রতিশোধের খায়েশ মেটাতে। তার টার্গেটে রয়েছেন শিল্পী, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। এটার লক্ষ্য হলোÑডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার যে কথা রয়েছে সেসময় দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিকে (বাংলাদেশ) একদলীয় শাসনের দেশে পরিণত করে ফেলা। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিরোধীরা নির্বাচনকে দেখছে তাদের শেষ লড়াই হিসেবে। অপরদিকে শেখ হাসিনার সহযোগীরা বলছেন, অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে কোনো ভাবেই বিএনপিকে জিততে দেওয়া যাবে না। কারণ তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা আমাদেরকে ‘হত্যা করবে’।
একটি সাক্ষাৎকারের সময় বিরোধীদের হয়রানি করার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। তিনি সে সময় তার এক সহযোগীকে একটি ছবির অ্যালবাম নিয়ে আসতে বলেন। সেই অ্যালবামজুড়ে ছিল অসংখ্য অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য হামলার পর বিকলাঙ্গ মৃতদেহের গ্রাফিক ছবি। তিনি বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক নয়। এরপর বিএনপি’র ‘বর্বরতার’ উদাহরণ হিসেবে তিনি ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, তাদের অপরাধের কারণেই এই বিচার হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের প্রায় ৮০০ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪০০ জনেরও বেশি নিখোঁজ হয়েছে। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন একই কাজ করেছিল। তার দলের সমর্থকদের জেলে পুরা ও হত্যা করা হয়। তারাই (বিএনপি) এটা শুরু করেছে।
গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের গল্প হচ্ছে মূলত দুই শক্তিশালী নারীর মধ্যে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার। তাদের একজন হচ্ছেন শেখ হাসিনা, যা বয়স ৭৫ বছর এবং অন্যজন হচ্ছেন ৭৭ বছর বয়সী বিএনপি নেত্রী ও বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৭১ সালে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব থেকে বড় নেতা ছিলেন। দেশ স্বাধীনের চার বছর পর তিনি একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৈরি হওয়া চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রীই হচ্ছেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানও ১৯৮১ সালে সৈন্যদের হাতে নিহত হন। এরপর অধিকাংশ সময়টাতে এই দুই নেত্রীই বাংলাদেশের গণতন্ত্রে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন।  
শেখ হাসিনা বলেন, আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটা ছিল আমারই। এই বিরোধীদল গঠন করেছিল একজন সামরিক স্বৈরশাসক। অপরদিকে বিএনপি দাবি করে যে, শেখ হাসিনার পিতা একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তারাই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন শেখ হাসিনা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হয়। এখন তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় এখন তিনি টেলিভিশন দেখা এবং সংবাদপত্র পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। তার ছেলে তারেক রহমান ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে, যা বিএনপি অস্বীকার করে। বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তারেক রহমান। এমন অবস্থায় দলের কান্ডারি-নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে ৯৩টি মামলা। এর পেছনেই বড় একটি সময় ব্যয় করতে হয় তাকে।
বিগত বছরগুলোতে নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবার কারণে বিরোধীদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছেন শেখ হাসিনা।
মহামারির কারণে বৈশ্বিক চাহিদা ব্যাহত হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন তার পোশাক শিল্পকে আগের ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। তবে এমন সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে আমদানি করা জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশে ডলারের সরবরাহ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, এটি আমাদের অর্থনীতিতে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধীদের দাবি অস্বীকার করেছেন শেখ হাসিনা। ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতি, নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাবনা নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ সেটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে রাজপথে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছিল সরকারের দ্বারা নির্যাতিত বিরোধী দল। জুন মাসে একটি বিশাল সমাবেশের সময় বিএনপির বক্তারা অবাধ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান। ঢাকার রাজপথে বিরোধীদের বিক্ষোভ উত্তপ্ত পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছে।
এসময় পাল্টা একটি সমাবেশ আয়োজন করে শাসক দল আওয়ামী লীগ। সেখানে বক্তারা স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকে নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ভিসা বিধিনিষেধের হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সফর করেছেন।
সমাবেশের কয়েক সপ্তাহ পর বিএনপি যখন আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করে তখনি ক্ষমতার চিন্তায় অস্থির হাসিনা সেটাকে বলপ্রয়োগে দমন করে। দলটির কর্মীরা বড় সমাবেশ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠি চার্জ ও টিয়ার গ্যাস হামলা চালায়। নতুন করে ৫০০ মামলা দেওয়া হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই ক্র্যাকডাউন এটাই প্রমাণ করে যে, পশ্চিমারা সতর্ক করলেও তা শেখ হাসিনার মতো নেতার ওপর সীমিত প্রভাব ফেলেছে। তিনি এশিয়ার দুই প্রধান শক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচারকের সামনে প্রমাণ উপস্থাপন করার আগেই অভিযুক্তরা মাসের পর মাস জেলে কাটান। এছাড়া জেলে তাদের হযরানি বা নির্যাতনের ঝুঁকি থাকে। আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেলে, সরকার এটিকে একটি মহান উপহার হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু এ ব্যক্তিটিকে প্রথমেই যে আটক করা উচিত ছিল না তা অবশ্য মেনে নেয়া হয় না।