শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আলুর মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট!

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৫০ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার

 

ক্রেতাদের উদ্বেগ আর ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্টদের মনিটরিংয়ের পরও লাগাম টানা যাচ্ছে না আলুর দাম বৃদ্ধির। এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে আলুর দাম বেড়েছে আরও ১০ টাকা। অর্থাৎ ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৫০০ টাকা। পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও কেন দাম বাড়ছে, তা নিয়ে অসন্তোষ আর নানা প্রশ্ন বিরাজ করছে দেশের আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জের ভোক্তাদের মাঝেও। অভিযোগে প্রকাশ, মধ্যস্বত্তভোগী আর সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে হিমাগার থেকে বাজারে পর্যাপ্ত আলুর সরবরাহ না করে সংকট দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমেই বাড়ানো হচ্ছে দাম। এতে একদিকে অত্যধিক মুনাফায় পকেট ভারী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের আর বিপাকে পড়ছে সাধারণ ভোক্তারা।

সরেজমিন জেলার কয়েকটি বাজারে ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়। পাইকারি বাজারে ৩৮-৩৯ টাকা। গত মাসে খুচরা বাজারে দাম ছিল ৩৮-৪০ টাকা আর পাইকারি বাজারে ছিল ২৭-২৮ টাকা। অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, এ বছর মুন্সীগঞ্জে হেক্টরপ্রতি আলু উৎপাদনে গড়ে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছ ৩০ দশমিক ৭৫ টন বা ৩০ হাজার ৭৫০ কেজি। অর্থাৎ মাঠে এ বছর আলুর কেজিপ্রতি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। পরিবহন খরচ ও হিমাগার সংরক্ষণ মিলিয়ে খরচ ১৬-১৭ টাকা, যা বাজারে ভোক্তাদের ক্রয় করতে হচ্ছে এখন ৫০ টাকা দামে। আর মৌসুমের শুরুতে কৃষক পর্যায় থেকে ব্যবসায়ীরা এবার আলু বস্তাপ্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় ক্রয় করেছিলেন, সেসব বস্তা আলু এখন বিক্রি করছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ১ হাজার ৯৫০ টাকা দামে। হিমাগার খরচ পুষিয়ে বস্তায় তাদের লাভ দাঁড়াচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থাৎ কেউ যদি ১ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করে থাকেন, বর্তমান বাজারে বিক্রিতে লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ লাখ টাকা, আর ১০ হাজার বস্তা সংরক্ষণ করে থাকলে লাভের অঙ্কটা কোটির ঘরে। ভোক্তারা বলেছে লাভের এমন প্রেক্ষাপট বলে দেয় ব্যবসারীদের হাতে থাকা আলু এখন রীতিমতো ‘আলাদিনের চেরাগ’।

ব্যবসায়ীরা সংকটের কথা বললেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে এ জেলায় ১০ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। এখনো জেলায় সচল হিমাগারগুলোতে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ টন আলু মজুত রয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৮০ টন খাওয়ার আলু ও ৭৭ হাজার ৫৮১ টন বীজ আলু। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে জেলার হিমাগার থেকে বাজারজাত করা হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার ৭৭৩ টন আলু।

জেলা কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ বি এম ওয়াহিদুর রহমান জানান, এ জেলায় খাদ্যচাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। সংকটের অজুহাতে মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক।

দিশেহারা রংপুরের আলুচাষি।

এ বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে কৃষকদের হাতে আর বেশি আলু নেই। কোনো হিমাগারে যদি ২ লাখ বস্তা আলু থাকে, তাহলে ২০ হাজার বস্তা কৃষকদের আর বাকি সব ব্যাপারীদের। পূর্বে যেভাবে হিমাগার থেকে আলু বাজারজাত করা হতো, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা এখন ভিন্নভাবে হচ্ছে। আগে ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে যে যার ইচ্ছে মতো আলু বাজারজাত করত, এখন নিয়ম করে পর্যায়ক্রমে সেটি করা হচ্ছে। আগে যেখানে একটি হিমাগার থেকে প্রতিদিন চার ব্যবসায়ীর চার ট্রাক আলু বাজারে যেত, সেখানে এখন দুই ব্যবসায়ীর দুই ট্রাক বাজারে যায়। ফলে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম থাকায় দাম  বেড়ে যাচ্ছে।

তারা আরও বলেন, বর্তমানে পাইকারিতে ৩৮-৩৯ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ৫০ কেজির এক বস্তা আলুর দাম ১ হাজার ৯০০ টাকা। প্রথম পর্যায়ে এসব আলু ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে ১৪-১৫ টাকা কেজি দরে প্রতি বস্তা ৭০০-৭৫০ টাকায় ক্রয় করেছিলেন। জমি থেকে হিমাগারজাত করতে ২৩০-২৫০ টাকা খরচ। সব মিলিয়ে ১ হাজার টাকা হলেও বর্তমান বাজারে সেসব ব্যবসায়ী সেসব বস্তা বর্তমানে বিক্রি করছেন ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার। প্রতি বস্তায় আলুতে ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এমন লাভ ধরে রাখতেই সিন্ডিকেট কাজ করছে। পাইকারি বাজারের প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে। সূত্রটি আরও জানায়, সিন্ডিকেটের পাশাপাশি দাম বাড়ার আরেক কারণ হলো হাতবদল। হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ রেখেই রসিদ বা হস্তান্তর ছাড়াই ব্যবসায়ীদের ক্রয়-বিক্রয় প্রচলিত রয়েছে। এতে প্রতি হাতবদলেই দাম বেড়ে যাচ্ছে আলুর।