পুলিশ হেফাজতে দুদক কর্মকর্তার মৃত্যু: মামলাটি ছিল ‘গায়েবি’
নিউজ ডেস্ক
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫৪ পিএম, ৬ অক্টোবর ২০২৩ শুক্রবার
চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর (৬৪) বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। নিহতের পরিবারের দাবি, মামলাটি সাজানো। সন্ত্রাসীরা চাহিদার ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে মিথ্যা তথ্যে এক গৃহবধূকে বাদী সাজিয়ে এ ‘গায়েবি’ মামলা করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মারা যাওয়া দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদীর নাম রনি আক্তার তানিয়া (২৬)। বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের রত্নপুর গ্রামের মোহাম্মদ হাশেমের মেয়ে। তিনি নগরীর এক কিলোমিটার এলাকায় বসবাস করেন। তিনি শহীদুল্লাহর ঘরে গৃহকর্মী ছিলেন দাবি করে এ মামলা করেন।
মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। যার সি আর নং-৭৩৩। গত ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গত শনিবার পরোয়ানাটি চান্দগাঁও থানায় আসে। এ মামলায় দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে (৩৫) আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ‘মামলার বাদী রনি আক্তার তানিয়া গত জানুয়ারি থেকে তিন হাজার টাকা বেতনে শহীদুল্লাহর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেন। প্রথম দুই মাস (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) বেতন ঠিকমতো দিলেও পরবর্তী মাসগুলোতে কখনও এক হাজার আবার কখনও দেড় হাজার টাকা শোধ না করে বকেয়া রাখা হয়। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তার সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতন বকেয়া ছিল। ২৩ আগস্ট রাতে টাকার জন্য গেলে শহীদুল্লা তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। একপর্যায়ে তার নির্দেশে তার শ্যালক কায়সার আনোয়ার তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন।’
শহীদুল্লাহর শ্যালক কায়সার বলেন, ‘রনি আক্তার তানিয়া নামে কোনও গৃহকর্মী আমার বোনের বাসায় কখনও ছিল না। অথচ তানিয়া নামে এক গৃহবধূ নিজেকে গৃহকর্মী দাবি করে মিথ্যা মামলা করেছে। এটি সাজানো গায়েবি মামলা। কিছু সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ এ মামলাটি করিয়েছে। পুলিশ তদন্ত না করেই এ মামলায় দুলাভাই মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে রাতের বেলায় সাদা পোশাকে এসে টেনেহিঁচড়ে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে গেছে। তিনি অসুস্থ মানুষ। তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ-ইনহেলার পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। পুলিশের টর্চারে আমার দুলাভাই মারা গেছেন।’
শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী রনি আক্তার তানিয়া বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী ম্যাক্সিমা চালক। তিন সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসার। মাঝে-মধ্যে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করতেন। তার কথায় আমি মামলা করেছি। মামলার বিবাদীর সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। তার বাসায় আমি কখনও কাজও করিনি। শুনেছি, মামলার আসামি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গ্রেফতারের পর থানায় নাকি মারা গেছেন। খবরটি শুনে আমার খারাপ লেগেছে। সাংবাদিক যারা ফোন করছেন, তাদের আমি সত্যি কথাটা বলে দিচ্ছি।’
শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহিদ বলেন, ‘আমার মায়ের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একটি জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। রাজনৈতিক নেতা জসিমসহ আরও কয়েকজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক বিনা কারণে আমাদের ঘর নির্মাণে বাধা দিয়ে আসছিল। তারা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। আমরা টাকা দিতে রাজি হইনি। এরপর আমাদের পুরো জমি তারা জোর করে দখল করতে চেয়েছিল। গত ১৮ আগস্ট তারা আমাদের ভাড়া দেওয়া ঘর ভাঙচুর করেছিল। এ ঘটনায় আমার বাবা বাদী হয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে চান্দগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। মামলাটি দায়ের করার কয়েকদিন পর অপরিচিত এই নারীকে গৃহকর্মী সাজিয়ে আদালতে মিথ্যা-বানোয়াট এ মামলা দায়ের করেছে তারা। আমার বাবাকে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত আমরা জানতাম না আমার বাবার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা হয়েছিল। এ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে বাবাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার চাচারা এবং বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী থানায় যান। আমার বাবাকে থানায় নেওয়ার পর কেউ যাতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে না পারেন সেজন্য চান্দগাঁও থানার মূল ফটক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তিনি হার্টের রোগী। তার সব সময় ইনহেলার আর মেডিসিন প্রয়োজন হয়। পুলিশ ইনহেলার ও মেডিসিন বাবার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
জানা গেছে, ১৮ আগস্ট ভাড়া দেওয়া ঘর ভাঙচুর, অবৈধ দখলের চেষ্টা এবং ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে চান্দগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯ আগস্ট দায়ের করা মামলায় তিনি নয় জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও চার থেকে পাঁচ জনকে অজ্ঞাত আসামি করেন। এ মামলার আসামিরা হলো– মো. জসিম উদ্দিন (৩৭), মো. জসিম উদ্দিন (৪৬), মো. শাহজাহান (৪৭), মো. শাহীন (৪৩), মো. লিটন (৪৭), মো. মান্নান (৪৫), নুসরাত তাসু (২৩), মো. রিফাত (৩৮) ও মোছা. বানু (৪৭)।
শহীদুল্লাহর স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার বলেন, ‘আমার স্বামী মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় চকবাজার কেয়ারিতে মিটিংয়ে যাচ্ছেন বলে বাসা থেকে বের হন। পরে শুনলাম, চেয়ারম্যান ঘাটার এক পরিচিত জনের ফার্মেসি থেকে তাকে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকে দুই ব্যক্তি টেনেহিঁচড়ে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে খবর আসে আমার স্বামী মারা গেছেন। আমার স্বামীকে পুলিশ টর্চার করে, নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। আমরা এর বিচার দাবি করছি।’
সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে গ্রেফতার করেছিলেন চান্দগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা হলেন– চান্দগাঁও থানার এএসআই মো. ইউসুফ আলী এবং এএসআই এটিএম সোহেল রানা। তারা সাদা পোশাকে অভিযান চালিয়ে শহীদুল্লাকে গ্রেফতার করেন। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) তাদের চান্দগাঁও থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিএমপির পুলিশ লাইনসে তাদের সংযুক্ত করা হয়।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গত ১৯ সেপ্টেম্বর জমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে নয় জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। আমরা তার মামলা গ্রহণ করেছি। ওই মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহীদুল্লাহকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতারের পর শরীর খারাপ লাগছে বলে জানান। তখন আমার কক্ষে এনে বসিয়েছি। পরে তার ভাইদের জানিয়ে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে থানায় কোনও প্রকার নির্যাতন করা হয়নি।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-পিআর) স্প্রীনা রানী প্রামাণিক বলেন, ‘দুদকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বুধবার (৪ অক্টোবর) তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিএমপি। তিন সদস্যের এই কমিটিতে আছেন– সিএমপির ডিবি (উত্তর) বিভাগের উপ-কমিশনার, সিএমপির উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এবং সিটিএসবির সহকারী কমিশনার। অনুসন্ধান শেষে মতামতসহ আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।’
সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন এক কিলোমিটার মহুরি বাড়ি এলাকার পৈত্রিক বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি সর্বশেষ চট্টগ্রামের দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ২০০৭ সালের ১২ জুলাই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।