মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হাছন জানের রাজা মঞ্চস্থ

ঘোর লাগা এক সন্ধ্যা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:২৩ এএম, ৭ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার



খাইরুল ইসলাম পাখি
ক’মাস আগেই জেনেছিলাম গীতল নাটক “হাছন জানের রাজা” নিউইয়র্ক শহরে আসছে। তাই ক্যালেন্ডারের পাতায় অক্টোবরের এক তারিখ গোল করে রেখেছিলাম দুটি কারণে, প্রথমত নাটকটি প্রিয় অগ্রজ শাকুর মজিদের লেখা আর দ্বিতীয় কারণ আমিও যে নাটকের মানুষ। তাই নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘন্টাখানেক পূর্বেই হাজির হলাম অকুস্থলে। অধরা পার্কিংও জুটলো দ্বৈবক্রমে, একেবারে অডিটোরিয়ামের উল্টোদিকেই।
হলের সামনেই দেখা হলো অনেকের সাথে। কুশলাদি বিনিময় হল, শুরু হল আড্ডাও। এ ধরনের ইভেন্ট হলে অনেকের সাথে একই স্থানে দেখা হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে শো শুরু হতে কিছুটা দেবীর কারণে সবার আড্ডার সময়টাও যেন বর্ধিত হল। সময়টা সবাই উপভোগই করছিল। অন্যদিকে কখন শুরু হবে নাটক এ প্রশ্নটিও ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবার চোখে মুখে ছিল বাড়তি আগ্রহ আর আকুতি। কারণ সুদূর ভার্জিনিয়া থেকে এসেছে ‘একতারা’ তাদের পরিবেশনা নিয়ে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ আসন গ্রহণের পালা শুরু হয়। ক্রমে ক্রমে অডিটরিয়াম ভরে উঠলো নানা বয়সী দর্শকদের সমাগমে। শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। পৃষ্ঠপোষক আর আয়োজকদের কথামালা। তারপরই একতারার কর্মযজ্ঞ নিয়ে বয়ান করলেন একজন। অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ নাটক শুরুর ঘোষণা। সবাই নড়ে চড়ে নীরব হয়ে বসলাম।
আলো আঁধারীর নীরবতা ভেঙে আলোর ঝলকানিতে শুরু হল হাছন জানের রাজা। কথায় আছেÑ মর্নিং সো’জ দ্য ডে। একতারা শুরুতেই জানান দিয়ে দিল তাদের শক্তিমত্তার কথা। কিছুক্ষণের মাঝেই দর্শকদের করতালিও জানান দিল, তাদের ভালোলাগার কথা। তারপর থেকে ক্ষণে ক্ষণেই এর পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল দর্শকরাও হাছন রাজার মতোই যেনো হাছন জানের রাজায় প্রেমাসক্ত হয়ে গেছে। শোর শেষেও সে ঘোরে দর্শকরাও যেন কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল অনেকক্ষণ। অন্তত আমার তা মনে হয়েছে।
নাটকটি দেখতে যাওয়ার আগে আমার যে ভাবনা ছিল তা ছাপিয়ে গিয়েছে একতারা। অভিনন্দন একতারার সকলের প্রতি। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে একতারার প্রধান এসকে মিলন যিনি নাটকটির নির্দেশক, ফোন করে অনুরোধ করেছিলেন নাটকটি দেখবার জন্য। বলেছিলাম যাব বৈকি, এটা আমার কর্তব্যের মাঝে পড়ে। তার কথায় অগাধ বিনয় ছিল, প্রেম ছিল। এই বিনয় ছাড়া বা প্রেম ছাড়া এত বড় দল আর এতো বড় প্রোডাকশন করা যায় না! আমি নিঃসন্দেহ যে, দলের সবাই বাঙালি কৃষ্টি তথা শিল্প সংস্কৃতির মহাপ্রেমিক, তাদের দল প্রধানের মতোই। অভিনন্দন আপনাদের সবাইকে। বিদেশ বিভূঁইতে এমন বিশাল দল নিয়ে এমন কলেবরে একটি নাটক করা কত যে শক্ত, তা অনুমান করতে পারি। কতজন কতশত ঘন্টা কতশত অর্থ ব্যয় করেছেন তাও ভাবতে পারি। নিছক শিল্পমোহ ও শেকড়ের প্রতি নাড়ির টান ছাড়া এসব করা যায় না। এগুলো করে যেখানে অর্থ আয় হয় না বরং অর্থ ব্যয় হয়, সেখানে কালে ভদ্রে পাওয়া মানুষের ভালোবাসাই হয়তো একমাত্র প্রাপ্তি ও সান্তনা। সাথে আর পাওয়ার মাঝে যা কিছু তা হল, শিল্পকর্মী বা শিল্পীর আত্মতুষ্টি।
আমি নাট্য বিশারদ বা নাট্য সমালোচক নই বরং সাধারণ এক নাট্যকর্মী ও দর্শক। তাই আমার কাম্য নয় নাটকটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা। কোন একটি কাজ করতে গেলে ক্বচিৎ বা অনাকাক্সিক্ষত ভুলচুক হয়েই যায়, নতুন পরিবেশ হলে তো হয়ই। এটা সেটা না বলে শুধু বলব যে, আপনাদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও আবেগ আপনাদের কাজের ভেতরেই প্রত্যক্ষ করা গেছে, এই মঞ্চায়নের মাঝেই।
৭ থেকে ৭০ বছরের প্রতিনিধিদের দেখলাম একই মঞ্চে, একই ছন্দে ভাসতে ও ভাসাতে। তাই  নাটকের সমস্ত কলাকুশলী, নাট্যকার, নির্দেশক, কোরিওগ্রাফার, নৃত্যশিল্পীবৃন্দ, কোরাস, সংগীত, আলোসহ যে যেখানে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, আপনাদের সবাইকে আবারো অভিনন্দন। পরিশেষে কৃতজ্ঞ চিত্তে একতারা-কে বলবো, আপনারা সত্যি সত্যি নিউইয়র্কের মঞ্চ আলোকিত করে গেলেন। যা কিনা নিউইয়র্কের দর্শক তথা শিল্পমনা সবাইকে রোমাঞ্চিত ও আন্দোলিত করেছে। জয় হোক একতারার, জয় হোক বাংলা নাটকের, জয় হোক বীর বাঙালির।