বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ পাশ কাটানোর চেষ্টা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১০:৪২ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ পাশ কাটিয়ে দেশের ২০টি জেলা সদর হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেশিন ক্রয়ের চেষ্টা চলছে। দেশের জেলা সদর হাসপাতালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে এ খাতে বড় ধরনের অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। বিশেষ করে বিশ্বে মহামারি কোভিডের সময় জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশকে ১ হাজার ১২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলা হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য গৃহীত প্রকল্পের জন্য আলাদা বাজেট দেওয়া হয়। ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ (ইআরপিপি) প্রকল্পের আওতায় ২০টি জেলা সদর হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য রাখা হয় ৮০ কোটি টাকা।
বারাদ্দকৃত অর্থে ডব্লিউএইচওর সুপারিশ অনুযায়ী অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাইক্রোওয়েভ মেশিন কেনার কথা। কিন্তু দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে মাইক্রোওয়েভের নামে কৌশলে মিশ্র প্রযুক্তির যন্ত্র সরবরাহের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই এমন সুযোগ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
জনস্বাস্থ্যবিদরা জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইনসেনারেশন, অটোক্লেভ ও মাইক্রোওয়েভ নামে তিনটি প্রযুক্তি রয়েছে। ইনসেনারেশন প্রযুক্তি নিষিদ্ধ। অন্যদিকে, অটোক্লেভ পুরোনো এবং ব্যয়বহুল প্রযুক্তি। অটোক্লেভ প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্তকরণ এবং বর্জ্য ধুয়ে ফেলতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। বর্জ্য পোড়াতে হয় বলে এতে বায়ুও দূষণ হয়। এছাড়া ভেজাল বর্জ্যরে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
অন্যদিকে, মাইক্রোওয়েভ সর্বাধুনিক এবং বিশ্বে বহুল প্রচলিত। মাইক্রোওয়েভে বর্জ্যগুলো আগের তুলনায় ৮৫ শতাংশ কম জায়গা দখল করে এবং ২৫ ভাগ ওজন কমায়। জীবাণুমুক্ত বর্জ্যগুলোকে কাজে লাগানো যায়। বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেশিন ক্রয়ে জন্য ৩০ আগস্ট সিঙ্গেল লটে ৮০ কোটি টাকার প্রযুক্তি ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৬ অক্টোবর দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। কিন্তু টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে দেখা যায়, সর্বাধুনিক মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি কেনার নামে জটিল ও ব্যয়বহুল অটোক্লেভ এবং মাইক্রোওয়েভের মিশ্র প্রযুক্তি কেনার চেষ্টা চলছে। মূলত পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের মিশ্র প্রযুক্তির স্পেসিফিকেশন তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ইআরপিপি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে ইআরপিপি প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী যুগান্তরকে বলেন ‘আমাদের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাইক্রোওয়েভ এবং অটোক্লেভ দুটি একসঙ্গে থাকলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা হয়। বিশ্বের অনেক দেশে দুই পদ্ধতিই ব্যবহরা হয়। অনেক কোম্পানি দুটি প্রযুক্তিই এক সঙ্গে তৈরি করে থাকে। বিশ্বব্যাংক যখন রিভিউ করে সেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হয়। তাছাড়া দেশে এটি প্রথম আন্তর্জাতিক দরপত্র যেটি ইজিপিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো অংশগ্রহণকারী আপত্তি বা সংশোধনী দেয়নি। উন্নত বিশ্বের অনেকে দেশ প্রয়োজন অনুসারে অটোক্লেভ, মাইক্রোওয়েভ বা দুটির মিশ্র প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আমাদের জন্য যেটি ভালো হবে সেটি রাখতে চাই। দরপত্র কোন প্রতিষ্ঠান পাবে তা বলা মুশকিল।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মেডিকেল বর্জ্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিকভাবে ধ্বংস করা না হলে সংক্রামক রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অটোক্লেভের চেয়ে মাইক্রোওয়েভ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। বিএসএমএমইউতে এটি ব্যবহার হচ্ছে। যদি ইআরপিপি প্রকল্পের দরপত্রে মাইক্রোওয়েভ মেশিনের বিষয় উল্লেখ থাকে, সেটাই আনা উচিত। এর চেয়ে আরও কোনো নতুন প্রযুক্তি থাকলে সেটা আনতে হবে। বিশ্বের অনেকে দেশেই এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
দরপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাইক্রোওয়েভের নামে মিশ্র প্রযুক্তি কেনা হচ্ছে। যদিও দরপত্রের সাধারণ স্পেসিফিকেশনে আগুনে পোড়ানের বয়লারের কথা বলা হয়েছে। স্টিম জেনারেটরের কথাও আছে। বলা হয়েছে, প্রযুক্তিটি এমন হবে, যাতে মডেল ভেদে পরিচালনায় ১০০ থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত পানির দরকার হয়। এটি অপারেট করতে চার থেকে পাঁচজন জনবল লাগবে।
অন্যদিকে মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তিতে আগুনে পোড়ানোর কিংবা পানি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। প্রযুক্তিটি অটোমেটিক পদ্ধতিতে কাজ করে। এটি বায়ু দূষণরোধ করে। অপারেট করতে অল্প সময়ের জন্য মাত্র একজন মানুষের প্রয়োজন। ডব্লিউএইচও’র অত্যাধুনিক মাইক্রোওয়েভ মেশিনের সুপারিশ করছে। এরপরও ইআরপিপি কর্তৃপক্ষ এমনভাবে স্পেসিফিকেশন তৈরি করেছে, সেখানে বিশ্বখ্যাত মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। আবার শতভাগ অটোক্লেভ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারবে না। স্পেসিফিকেশনে উল্লিখিত তথ্যে একটি মিশ্র প্রযুক্তির চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে শুধু পছন্দের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান কেনাকাটার শর্ত অনুযায়ী যন্ত্রটি সরবরাহ করতে পারবে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইআরপিপি প্রকল্পের স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে মিল রয়েছে তুরস্কের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি ভারটিসার সঙ্গে। মহামারির সময় দেশটির এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হন্ডুরাসে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি সরবরাহে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে হন্ডুরাসের জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। এরপর হন্ডুরাস প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এর আগে এ প্রকল্পে ১২টি ভিন্ন ভিন্ন খাতে জাদিদ অটোমোবাইলস, এসআরএস ডিজাইন অ্যান্ড ফ্যাশন, সিম করপোরেশন, ই-মিউজিক এবং ব্রেইন স্টেশন ২৩ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগের সত্যতা পায় জাতীয় নিরীক্ষা অধিদপ্তর। ২০২০ সালে জাদিদ অটোমোবাইলসের মালিককে তলব করে দুদক। এরপর করোনা মোকাবিলায় সরকারের ওই প্রকল্প থেকে অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীরকে পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।