চাকরির সময়টুকু আমানত, এর খেয়ানত করবেন না
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৮:৪১ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
এক ব্যক্তি কোনো চাকরি করেন, সেখানে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করার অঙ্গীকার করেছে। এ আট ঘণ্টা সময় সে তার মালিকের নিকট বিক্রি করে দিল। কাজেই এ সময়টুকু মালিকের পক্ষ হতে তার কাছে আমানত।
যার চাকরিতে সে নিয়োজিত। এ আট ঘণ্টা থেকে মালিকের অনুমতি ছাড়া ভিন্ন কাজে ব্যয় করা আমানতের খেয়ানত। যেমন ডিউটি চলাকালে কোনো বন্ধু-বান্ধব আসার পর তাদেরকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করা, গল্পে মেতে ওঠা ইত্যাদি। অথচ মালিকপক্ষ হতে এসময়টুকু আমানত। এসময় নিজ প্রয়োজনে খাওয়া-দাওয়া বা গল্পে মেতে ওঠা আমানতের খেয়ানত।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমরা অন্যের অধীনে চাকরি করাকালীন নিজ কর্মে মগ্ন হয়ে বহু সময় কাটিয়ে দিই। উদাসীনতায় কাটিয়ে দিই আমানত স্বরূপ সময়টুকু। অথচ মাস শেষে বেতন ঠিকই নিচ্ছি। আমানতের খেয়ানত করার ফলে মাস শেষে বেতন পুরাপুরি গ্রহণ করা হালাল হবে না। যেহেতু মালিকপক্ষের দেওয়া সময়টুকুর যথাযথ ডিউটি পালন করা হয়নি।
ধার করা জিনিসও আমানত: ধার দেয়ার প্রথাটি একটি সামাজিক ব্যাপার। ধার দেয়া আমানতের বিশেষ একটি শাখা। যদিও আমরা এটাকে আমানত মনে করি না। আমানতের প্রতি আমরা যত্নবান নই। ধার করা বলা হয়, কোনো ব্যক্তির একটি জিনিস প্রয়োজন। নিজের কাছে নেই, অন্যের আছে। সে অন্য কোনো ব্যক্তি হতে এ জিনিসটি চেয়ে নিল এই বলে যে, আমাকে এ জিনিসটা কয়েক দিনের জন্য ব্যবহার করতে দাও। এভাবে কোনো জিনিস চেয়ে ব্যবহার করার নামই হলো ধার করা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এভাবে চেয়ে নেওয়া জিনিসও এক প্রকার আমানত। যেমন আমার একটি বই পড়ার খুব ইচ্ছে হলো। অথচ এটা আমার নিকট নেই। এজন্য আমি অন্য কোনো ব্যক্তি থেকে বইটি পড়ার জন্য চেয়ে নিলাম। আর তাকে বললাম বই পড়ার পর তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব। এখন এ বইটি যদিও আমি ধার করে এনেছি। এটি তার আমানত। কাজেই চেয়ে নেওয়া জিনিস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ওই জিনিসের মালিকের অপছন্দ ও অসন্তুষ্টিতে ব্যবহার জায়েয নয়। অর্থাৎ ওই জিনিস এমনভাবে ব্যবহার করবে না যেভাবে ব্যবহার করলে মালিকের মনে কষ্ট আসতে পারে। ধার করে চেয়ে নেয়া জিনিস যথাসময়ে মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া কর্তব্য।
প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দায়িত্বের খেয়াল রাখবে: যখন আমাদের মানসিকতা এমন হয়ে গেছে যে, নিজের হক আদায় কোনো ধরনের ত্রুটি না করে অন্যের হক আদায়ে গড়িমসি করার প্রবণতা বেড়েছে। অন্যের কাছ থেকে নিজের পাওনা আদায় করার ব্যাপারে সোচ্চার অথচ তার নিকট অন্যের পাওনা আদায় করার ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে রেখো! যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের দেখানো রাস্তায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরের হক আদায় করা সম্ভব হবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির একথা ভাবা উচিত যে, আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি তো? যখন এ কথা অন্তরে অনুভূত হবে তখন সবারই হক আদায় সম্ভব হবে। স্বামীর অন্তরে স্ত্রীর হক আদায়ের কথা থাকলে যে, আমি আমার স্ত্রীর হক আদায় করে দেব। এতে হক আদায় করা সহজ হয়ে যায়। অনুরূপ স্ত্রী স্বামীর হক আদায়ে, শ্রমিক মালিকের হক আদায়ে, মালিক শ্রমিকের হক আদায়ের প্রতি দিলের মধ্যে যদি অনুভূতি থাকে এতে করে পরস্পরের হক আদায় সম্ভব। আর যদি নিজের ওপর অর্পিত হক আদায় করার ব্যাপারে নিজেরা সচেতন না হই তা হলে হক আদায় করা নিয়ে দ্বন্দ লেগেই থাকবে। দাবি আদায় করার সংস্থা গঠন হবে, মিছিল হবে, মিটিং হবে কিন্তু প্রাপ্য অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় না আসবে। কাজেই দুনিয়াতে সুখ শান্তির একমাত্র পথ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথ। এ পথ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ওজনে কম দেয়ার মতো সময় কম দেয়া ও অপরাধ: ওজনে সঠিক দেয়া আমাদের নিকট আমানত।
যেমন পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ
الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ
وَإِذَا كَالُوهُمْ أَو وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
‘ওই সমস্ত লোকদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আজাব, যারা দেয়ার সময় ওজনে কম দেয় আর নেওয়ার সময় বেশি নেয়। এতে বিন্দু পরিমাণ কম হতে পারবে না। কিন্তু অন্যকে দেয়ার সময় পাল্লা বাঁকিয়ে রাখে।’ (সূরা মুতাফফিনি:১-৩)
তাদের উদ্দেশ্যেই উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। লোকেরা ওজনে কম-বেশি করা একথা দ্বারা শুধু বেচা-কেনাকে বুঝে থাকেন। বস্তুতঃ ওলামায়ে কেরামের ভাষ্য- التطفيف في كل شيء : প্রত্যেক কাজেই ওজনে কম-বেশি হয়ে থাকে। যেমন কোনো ব্যক্তির আট ঘণ্টা ডিউটি করার সময় ধার্য। সে ব্যক্তি আট ঘণ্টার চেয়ে কম ডিউটি পালন করাই হলো ওজনে কম করার শামিল। সে আজাবে গ্রেফতার হবে। সুতরাং এর প্রতি দায়িত্ববান হওয়া উচিত।
আমানতদার ব্যক্তিই সমাজের প্রতিনিধি হওয়া উচিত: বর্ণিত আছে, হজরত ওমর (রা.) মৃত্যুর পূর্বে গুরুতর হামলার শিকার হন। কিছু সংখ্যক সাহাবি তার নিকট এসে আরজ করলেন, আপনিতো আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আপনার পরবর্তী কাউকে খলিফা নিযুক্ত করার জন্য নাম ঘোষণা করুন। যেন আপনার পর হুকুমতকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। অনেকে আবার মতামত পেশ করলেন- আপনার পর আপনার ছেলে আবদুল্লাহ বিন ওমরের নাম ঘোষণা করুন যাতে আপনার ওফাতের পর তিনি খলিফা হতে পারেন। হজরত ওমর ফারুক (রা.) তার প্রতিউত্তরে বললেন, না। তোমরা আমার নিকট এমন এক ব্যক্তিকে খলিফা নিযুক্তের জন্য বলছো, যে তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
উল্লেখ্য যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) নিজ স্ত্রীকে (হায়েয) মাসিক ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে তালাক দিয়ে ছিলেন। মাসয়ালা হলো, ঋতুস্রাব চলাকালে মহিলাদেরকে তালাক দেওয়া নাজায়েয। হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) এর এ মাসয়ালা তখন জানা ছিল না। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন তখন তাকে বললেন, এটা তুমি অন্যায় করেছো। এ মহিলাকে তুমি তালাক দেয়া থেকে ফিরিয়ে নাও। একান্ত যদি তালাক দিতেই হয় তা হলে পবিত্রবস্থায় তালাক প্রদান করবে। হজরত ওমর (রা.) সাহাবিদেরকে উক্ত ঘটনার দিকে ইশারা করে বলেছিলেন, তোমরা এমন ব্যক্তিকে খলিফা নিযুক্ত করার কথা বলছো যে তালাক দেয়ার নিয়ম নীতিও জানে না।
হজরত ওমর (রা.) এবং খেলাফতের দায়িত্ব ও অনুভূতি: উক্ত ঘটনার পর হজরত ওমর (রা.) তাদের বললেন, মূল কথা হলো খেলাফতের বোঝা খাত্তাব বংশের এক ব্যক্তির গলায় পড়েছে। উদ্দেশ্য তিনি নিজেই ১২ বছর আছেন, এটাইতো অনেক। এখন এ বংশের অন্য কাউকে ক্ষমতার ফাঁদে ফেলতে চাই না। যখন আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমতার হিসাব দিতে হবে তখন কি অবস্থা হবে আমার?
অথচ হজরত ওমর (রা.) এমন ব্যক্তি যার সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ প্রদান করেছেন যে, হজরত ওমর জান্নাতে যাবে। এ সুসংবাদের পর জান্নাতে না যাওয়ার কোনো সংশয় থাকে না। তবু তিনি আল্লাহর নিকট হিসাব-নিকাশের ভয় এতটাই করতেন। ক্ষমতার আমানতদারির ব্যাপারে তিনি কতইনা সচেতন ছিলেন। তার ব্যাপারে এমন সুসংবাদের পরও তিনি একদা বলছিলেন- কেয়ামত দিবসে আমানতদারির হিসাব নেওয়ার সময় ফলাফলের ক্ষেত্রে যাতে আমার বিন্দু পরিমাণ এদিক সেদিক না হয়।
এ প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন যদি আমাকে এই আমানতের হিসাব-নিকাশের ফলশ্রুতিতে সমান সমান করে মাফ করে দেয়া হয় যে, আমার ওপর কোনো গুনাহও নেই, সাওয়াবও নেই আর আমাকে আ’রাফে (আরাফ হলো জান্নাত এবং জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। যাদের গুনাহ এবং সাওয়াব বরাবর হবে তাদেরকে আরাফে রাখা হবে।) ফেলে দেয়া হয় আমার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে। কারণ, আমি মুক্তি পেয়ে যাব। বস্তুতঃ হজরত ওমর (রা.) আমানতদারির ব্যাপারে এতটাই সচেতন ছিলেন যদ্দরুন তিনি একথা বলেছেন। তার এমন চরিত্রটা যদি আমাদের মাঝে কিছুটাও অঙ্কিত হয় তা হলে আমাদের অবস্থা অনেকটাই পাল্টে যাবে।
দফতরের আসবাবপত্র আমানত: যে দফতরে আপনি কর্মরত সেখানকার সব ধরনের আসবাবপত্র আপনার নিকট আমানত স্বরূপ। এ আসবাবপত্রগুলো দাফতরিক কাজে ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয়েছে। কাজেই ব্যক্তিগত কাজে ওই আসবাবসমূহ ব্যবহার করবেন না। কেননা এটাও আমানতের খেয়ানত। লোকেরা এটা মনে করে থাকে যে, এ সাধারণ আসবাবগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করলে কিইবা ক্ষতি?
মনে রাখবেন! খেয়ানত ছোট হোক কিংবা বড় জিনিস হোক সবই হারাম। গুনাহে কবিরাহ। উভয়টা আল্লাহর নাফরমানী। কাজেই এগুলো থেকে বাঁচা উচিত।
সরকারি জিনিসপত্র আমানত: উপরে বলা হয়েছে আমানতের অর্থ- কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির ওপর বিশ্বস্ততার ফলে তার কাছে কোনো কিছু সোপর্দ করল। এজিনিসটা যথা সময়ে পরিবর্তন ছাড়া ফেরত দেয়াই হলো আমানত। এর বিপরীত হলো খেয়ানত। তাই যে সব সরকারি যানবাহনে আমরা চলাফেরা করি, যেমন বাস, ট্রেন ইত্যাদি এগুলো সবই আমানত। এগুলো জায়েয পদ্ধতিতে ব্যবহার করা চাই। এগুলোর অপব্যবহার খেয়ানত। যেমন রাস্তা ঘাট ইত্যাদি সরকারি হওয়া সত্বেও লোকেরা যত্রতত্র ড্রেন, নালা ইত্যাদি করে রাস্তার ক্ষতি সাধন করে থাকে। নানাভাবে দখলদারিত্ব করে থাকে। কখনো কখনো রাস্তা দখল করে বাড়ি ঘর নির্মাণ করে রাখে। অথচ ফুকাহায়ে কেরাম এগুলোকে সম্পূর্ণ নাজায়েয বলেছেন। কেননা সরকারি আসবাবপত্র জায়গা জমি সবই আমানত। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ যতটুকু অনুমতি রয়েছে ততটুকুই ব্যবহার করতে পারবে। এর বেশি নয়।
আমানত থেকে খেয়ানতের দৃষ্টান্ত এতটাই যে, আমাদের গোটা জীবনে এমন কোনো পরিস্থিতি বাকি নেই, যার আমানতের হুকুম বিধি-বিধানর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কাজেই সবক্ষেত্রে খেয়ানত থেকে বাঁচা অবশ্যম্ভাবী। এগুলো সব দ্বীনের অংশ। আমাদের মধ্যকার কিছু লোক দ্বীনকে অত্যন্ত সংকীর্ণ বা সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দিলে এগুলোর ফিকির পয়দা করে দিন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথে আমাদেরকে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।