ইসলামে পুঁজি বিনিয়োগ পদ্ধতি
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৮:৪৪ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
মানুষ যা উপার্জন করে, তার সবটুকু ভোগ করে নিঃস্ব অবস্থায় থাকা বা পরবর্তীদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘নিজের কিছু মাল রেখে দাও, ইহা তোমার জন্য উত্তম।’ (সহীহ বুখারী)
অন্য এক হাদীসে এসেছে, ‘যদি তুমি তোমার সন্তানদেরকে সম্পদশালী রেখে যাও তাহলে তা উত্তম তাদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাওয়া থেকে যে, তারা মানুষের ধারে ধারে ঘুরবে। (সহীহ বুখারী)
আল কোরআনে এসেছে, ‘তুমি তোমার হাত ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্তও করে দিয়ো না। তা হলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সূরা বনী ইসরাইল-২৯) অর্থাৎ একেবারে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে বলবে, ‘লোকটি কৃপণ, বড় বখিল! আর সবকিছু দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলে বলবে, এত কেন দিয়েছে, আজ নিজেই মানুষের ধারে ধারে ঘুরছে! এ-জন্য আমাদের উচিত আয় থেকে সামান্য হলেও রেখে দেয়া।
দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে, কোনো সম্পদ ঘরে অলস ফেলে রাখলে, খরচ হতে হতে তা একদিন ফুরিয়ে যায়। একটি হাদীসেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ জেনে রেখো! তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা সম্পদশালী ইয়াতিমের দায়িত্ব নিলে, সে যেন ইয়াতিমের মাল ব্যবসায় খাটায়; অলস ফেলে না রাখে। কারণ, (অলস ফেলে রাখলে) তার জাকাত দিতে দিতে একদিন ফুরিয়ে যাবে। (তিরমিযী শরীফ)
এ জন্য দৈনন্দিনের প্রয়োজন ও আত্মীয় স্বজনের হক আদায়ের পর অতিরিক্ত সম্পদ অলস ফেলে না রেখে বরং এগুলোকে উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে। কেননা, পুঁজি বা উৎপাদনের অন্যান্য মাধ্যমগুলোকে আয়ের জন্য বিনিয়োগ না করে অলস ফেলে রাখা, শুধু অর্থনীতির দিক থেকেই ক্ষতিকর নয় বরং দ্বীন ও শরীয়তের দিক থেকেও অপছন্দ।
প্রচলিত বিনিয়োগ পদ্ধতি
প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থায় মানুষ তার রেখে দেয়া পুঁজি নি¤েœাক্ত পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে-
এক. সুদ ভিত্তিক বিনিয়োগ
(ক) কোন কোন ব্যক্তি নিজের পুঁজিকে ব্যাংকের লাভজনক সুদী একাউন্টে জমা রেখে বা কোন ব্যবসায়ীকে সুদের ভিত্তিতে ঋন দিয়ে প্রতি মাসে বা নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্দিষ্ট হারে সুদ নেয়।
(খ) সুদি বিভিন্ন সার্টিফিকেটে পুঁজি বিনিয়োগ করে সুদ নেয়া।
দুই. কোম্পনির শেয়ার ক্রয়
জয়েন্ট স্টক কোম্পানির শেয়ারে কেউ কেউ পুঁজি বিনিয়োগ করে। ঐ কোম্পানি বিভিন্ন কারবার করে যা লাভ করে, বছরের শেষে তা শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে আনুপাতিক হারে বণ্টন করে। বর্তমানে সত্তাগতভাবে শেয়ারও পুঁজি বিনিয়োগের একটা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখিত পদ্ধতিগুলোর মাঝে, কোম্পানির শেয়ারে পুঁজি বিনিয়োগ কিছু শর্ত সাপেক্ষে বৈধ। বাকি দুটি সুদভিত্তিক হওয়ায় সম্পূর্ণ নিষেধ।
ইসলামের পুঁজি বিনিয়োগ পদ্ধতি
এক. মুরাবাহা
শরয়ী পরিভাষায় মুরাবাহা বলা হয়, ক্রয়কৃত মূলের সাথে অতিরিক্ত লাভের পরিমান উল্লেখ করে বিক্রি করা। মুরাবাহার ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগের পদ্ধতি হচ্ছে, কোন ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য ঋন দেয়ার পরিবর্তে, ঐ জিনিস ক্রয় করে নির্দিষ্ট পরিমান লাভ যুক্ত করত বেশি দামে তার নিকট বিক্রি করা। সরাসরি পুঁজি বিনিয়োগ করলে যে সুদ হিসেবে যা আসতো, এখানে তা আসবে ক্রয়-বিক্রয়ের লাভ হিসেবে। এ জন্য ইসলামী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মুরাবাহা মূলত বিনিয়োগ পদ্ধতি নয় বরং ক্রয়-বিক্রয়েরই একটা প্রকার।
মুরাবাহার ভিত্তিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়, মুরাবাহার উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঐ পণ্য কিনে নিজের কবজায় নিয়ে তারপর গ্রাহকে বুঝিয়ে দেয়া। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা খোদ গ্রাহকেও উকিল বানানোর অনুমতি আছে। তবে এখানে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নিম্নের বিষয়গুলো পাওয়া যেতে হবে।
এক. বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক প্রথমে ঐ পণ্যটি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে পরস্পর অঙ্গিকারাবদ্ধ হবে।
দুই. বিনিয়োগকারী, গ্রাহককে পণ্য কেনা ও কবজ করার উকিল বানিয়ে দিবে এবং উভয় উকালাতনামার উপর স্বাক্ষর করবে।
তিন. গ্রাহক উকিল হিসেবে পণ্য কিনে কবজ করবে।
চার. উকিল হওয়ার দরুণ, পণ্য গ্রাহকের কাছে আমানত হিসেবে থাকবে। এবং পণ্যের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থাকবে মক্কেল তথা বিনিয়োগকারীর উপর। তাই উক্ত সূরতে পণ্য কোনো কারণে নষ্ট হলে তা বিনিয়োগকারীর মালিকানা থেকে যাবে।
পাঁচ. পণ্য কেনা ও কবজের পর গ্রাহক বিনিয়োগকারীকে জানাবে এবং তার কাছ থেকে গ্রাহক পণ্য কেনার প্রস্তাব দিবে।
ছয়. বিনিয়োগকারী যখন এই প্রস্তাব কবুল করবে তখন তার মালিকানা গ্রাহকের কাছে চলে যাবে।
উল্লেখ্য, মূল্য আদায়ের গ্যারিন্টি হিসেবে গ্রাহকের কোনো জিনিস বন্ধক হিসেবে রাখা যেতে পারে। সাথে সাথে তার থেকে এই অঙ্গিকারও নেয়া যায় যে, নির্দিষ্ট সময় মূল্য পরিশোধ না করলে বিনিয়োগকারীর সমাজ কল্যাণ ফান্ডে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দান করবে। এই হলো মুরাবাহার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করার রূপরেখার সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
দুই. ইজারা পদ্ধতি সেবার বিনিময়ে অর্থ বা সেবার বিনিময়ে সেবা গ্রহনের ওপর যে চূক্তি হয়, শরয়ী পরিভাষায় তাকে ইজারা বলে। ইজারা বা লিজ সত্তাগতভাবে অর্থ বিনিয়োগের কোনো পদ্ধতি নয়। বরং ক্রয়-বিক্রয়, উকালাত ইত্যাদির মতোই একটি চূক্তি। তবে বর্তমানে সুদি লেনদেনের বিপরীত ইজারাকেও বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। এই ইজারাকে ভরহধহপরধষ ষবধংব বলা হয়। ইহা প্রচলিত ইজারা থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। এই ইজারা পদ্ধতি হচ্ছে, কোনো কোম্পানির স্থায়ী উপকরণ যেমন মেশিন, পরিবহন ইত্যাদির প্রয়োজন। এখন কোম্পানি, পুঁজি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ঋন নিয়ে নিজে কেনার পরিবর্তে তাকে বলে যে, এই মেশিন কিনে আমার কাছে ভাড়া দাও।
বিনিয়োগকারী তা কিনে তার কাছে ভাড়া দিবে। নির্দিষ্ট একটা সময় ভাড়ায় কাটার পর, বিনা মূল্যে বা সামান্য একটা মূল্য ধরে ওই মেশিন বিনিয়োগকারী কোম্পানিকে দিয়ে দেয়। ভাড়ার সময় সাধারণত এতো লম্বা হয় যে, উক্ত সময়ে বিনিয়োগকৃত টাকা ও তার ওপর যতটুকু সুদ আসার সম্ভাবনা ছিলো, ভাড়া থেকে তা ওঠে আসে। এতে উভয়ের লাভ। কোম্পানির লাভ হচ্ছে, একসঙ্গে বেশি টাকা দিতে হয়নি। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজি দ্বারা লাভ কামানো উদ্দেশ্য, তার তা হয়েছে। ইজারা ভিত্তিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ও তার সমাধান শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহু এর কিতাব ‘বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়া মুআসারা’এ উল্লেখ আছে। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতে চাইলে তা অধ্যয়ন করে কর্ম কৌশল জেনে নিতে পারে।
তিন. মুদারাবা শরয়ী পরিভাষায় মুদারাবা বলা হয় এমন চূক্তিকে, যেখানে এক পক্ষ পুঁজি ও অপর পক্ষ শ্রম দিয়ে অংশগ্রহন করে। মুদারাবা অনেকটা সহযোগীতামূলক বিনিয়োগ পদ্ধতি। কারণ, সমাজে অনেকে এমন আছেন, যার পুঁজি রয়েছে কিন্তু শ্রম দেয়ার সুযোগ নেই। আবার কেউ কেউ আছেন, যার শ্রম দেয়ার সুযোগ আছে কিন্তু পুঁজি নেই। তো এখানে পুঁজিওয়ালা পুঁজি আর শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে। মুদারাবাকে কিরাদও (القراض) বলা হয়। শিরকত ও মুদারাবা এই দুটিই মূলত ইসলামের বিনিয়োগ পদ্ধতি।
মুদারাবা সার্টিফিকেট বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ প্রচলিত সুদী বন্ডের পরিবর্তে মুদারাবা বন্ড চালু করছে। মুদারাবাবন্ড হচ্ছে, বন্ডের ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে মুদারাবা চূক্তি। উল্লেখিত চূক্তিতে মুদারাবাবন্ডের ক্রেতা হচ্ছে পুঁজি বিনিয়োগকারী আর বন্ড বিক্রেতা হচ্ছে শ্রমদাতা। মুদারাবাবন্ডে পুঁজি বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট পরিমানে লাভ পায় না বরং শতকরা হারে লাভ হলে পায়। ব্যবসায় লাভ না হলে বিনিয়োগকারী কোনো লাভ পায় না। শ্রমদাতা, বিনিয়োগকারীকে প্রতিবার লাভ দেয়ার সময় নির্দিষ্ট সংখ্যক বন্ডের মূল্যও পরিশোধ করে দেয়। এ-ভাবে শ্রমদাতা আস্তে আস্তে বন্ডের মূল্য পরিশোধ করে বড় একটা প্রকল্পের মালিক হয়ে যায়। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীও তার পুঁজি দ্বারা লাভবান হয়। এ সংক্রান্ত জানার জন্য ‘শিরক ও মুদারাবা আসরে হাজের ম্যাঁ’ পৃষ্ঠ-৪৬৭ ও ‘বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়া মআসারা’ খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৩১ দ্রষ্টব্য।
চার. সলম সলম বলা হয় এমন ক্রয়-বিক্রয়কে যেখানে ক্রেতা অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করে আর বিক্রেতা পরবর্তীতে পণ্য বুঝিয়ে দেয়। যেমন একজন কৃষক ঋনের জন্য এসেছে, ফসল কাটার পর সুদ সহ টাকাটা সে পরিশোধ করবে। বিনিয়োগকারী তাকে সুদের ভিত্তিতে টাকা না দিয়ে, তার থেকে অগ্রীম মূল্যে শস্য কিনে নিতে পারে। এই পদ্ধতিকে শরয়ী পরিভাষায় সলম বলে। যে সকল পণ্য ওজন করে বিক্রি হয়, যেমন ধান, চাউল, চিনি এবং যে সকল পণ্য গজ হিসেবে, গননা করে বিক্রি হয় তাতে সলম জায়েজ। তবে গননাকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে সবগুলো সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি হওয়া শর্ত। একই কোম্পানির উৎপাদিত প্যাকেটজাত পণ্য, যেগুলো সাধারনত একই ধরনের হয়ে থাকে তাতে সলম চূক্তি জায়েজ। সলম সম্পর্কে জানতে হলে ‘আল মাআয়িরুশ শরয়ীহ’ পৃষ্ঠা-১৬৬. দৃষ্টব্য।
পাঁচ. শিরকত বা অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে, নির্দিষ্ট হারে লাভ বন্টন ও পুঁজি অনুযায়ী ক্ষতি বহনের ভিত্তিতে যে চূক্তি হয় তাকেই শিরকত বলে। ফকিহগণ শিরকতকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। একভাগে রেখেছেন ঐ সকল শিরকত যে গুলো ফিকহের প্রাচীন কিতাবগুলোতে বিদ্যমান। আরেক ভাগ হচ্ছে, যে গুলো ফিকহের প্রাচীন কিতাবগুলোতে নেই বরং পরবর্তীতে অস্তিত্যে এসেছে। বর্তমানের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এই দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত। তাই কোম্পানির শেয়ারে পুঁজি বিনিয়োগ মানে অংশীদারিত্বর ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত জানতে ‘আল মাআয়িরুশ শরয়ীহ’ পৃষ্ঠা-১৯৪ ও ‘শিরকত ও মুদারাবা আসরে হাজের ম্যঁ’ দৃষ্টব্য।
মুশারাকায়ে মুতানাকেসা মুশারাকায়ে মুতানাকেসাও অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগের একটি পদ্ধতি। এই লেনদেনের ধরন হচ্ছে, বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক মিলে কোনো বাড়ি নির্মাণ বা ক্রয় করে। তারপর অংশ অনুযায়ী দু’জন বাড়ির মালিক হয়। বিনিয়োগকারী তার অংশকে কয়েকটা ইউনিটে ভাগ করে গ্রাহকের কাছে ভাড়া দেয়। গ্রাহক ভাড়ার নীয়মতান্ত্রিক ভাড়া পরিশোধ করে আর সাথে সাথে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি করে ইউনিট কিনে নেয়। এ ভাবে সে এক সময় বাড়ির মালিক হয়ে যায়। বিনিয়োগকারীও লাভ সহ পুঁজি ওঠিয়ে নেয়। এটাও জায়েজ রয়েছে।