মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বহস্তে উপার্জন: অন্যতম ফরজ

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৮:৪৮ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

জীবন ধারণের জন্য পানাহার আবশ্যক। জন্মের পর থেকে প্রতিটি জীব তার খাদ্যের মুখাপেক্ষী। মানুষ তার থেকে পৃথক নয়।

মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্যের আবশ্যকতা চিরসত্য। একারণেই মানুষ রুজি রোজগারের পথে পা বাড়ায়। কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি, কেউ দিনমজুরী হিসাবে রুজির পথ বেছে নেয়। রুজি তালাশের বিষয়ে আল কোরআন বলছে,

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

 

وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ

তরজমা : যখন নামাজ শেষে হয়ে যায়, তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে এবং আল্লাহর যিকির করো বেশি করে যেন তোমরা সফলকাম হতে পারো। কতক লোক ব্যবসায় অথবা কোন খেলা দেখলো, তখন তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে সে দিকে ছুটে গেল। বলে দাও, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ব্যবসা ও খেলা অপেক্ষা অনেক শ্রেয়। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট রিযিকদাতা (সূরাতুল জুমআহ, আয়াত নং ১০-১১)।

রুজির মধ্যে কোন পথ উত্তম? ইসলামি ইতিহাসের উজ্জ্বল দিনগুলোতে এর সন্ধান ও হাদীসে রাসূলে (সা.) এর সন্ধান জরুরি। যদি আমরা ইতিহাসের আলোকে দেখি তাহলে দেখবো মানব ইতিহসের শ্রেষ্ঠ কাফেলা যাদের নিয়ে পৃথিবী আজও গৌরববোধ করে। সেই কাফেলার কথা আমাদের জানাচ্ছেন হাদীস শাস্ত্রেও মহাপণ্ডিত আল হাকিম (রহ.) তিনি ইবনে আব্বাসের (রা.) এর সূত্রে বয়ান করেন,

عن بن عباس رضي الله عنهما فقال ادن منى فاحدثم عن الأنبياء المذكورين في كتاب الله احدثك عن أدم إنه كان عبدًا حرّاثا، احدثك عن نوح إنه كان عبدًا نجارًا، احدثك عن ادريس إنه كان خياطا، احدثك عن داود إنه كان عبدًا زرّادًا، احدثك عن موسى إنه كان عبدًا رعيًا، احدثك عن ابراهيم أنه كان عبدًا زرّاعًا، احدثك عن عن صالح أنه كان عبدًا تاجرًا، احدثك عن سليمان أنه كان عبدًا أتاه الله الملك وكان يصوم في أوّل الشهر ستة أيام وفي وسطه ثلاثة أيام وفي أخره ثلاثة أيام وكانت له تسع مائة سرية، وثلاث مائة مائة فهرية

 

তরজমা : হজরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃষক ছিলেন, হজরত নুহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঠমিস্ত্রি ছিলেন, হজরত ইদ্রিস আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূচকর্মী ছিলেন, হজরত দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্মনির্মাতা ছিলেন, হজরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাখাল ছিলেন, হজরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃষিজীবী ছিলেন, হজরত সালেহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসায়ী ছিলেন, হজরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওষুধ প্রস্তুতকারক ছিলেন, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আজয়াদে’ ছাগল চরাতেন, হজরত হাওয়া (আ.) সুতা কর্তনকারিনী ছিলেন, এবং ইমরানের কন্যা মারয়ামও তাই করতেন। (সংক্ষিপ্ত মুসতাদরাকে হাকিম. হাদীস ৪১৬৫)

উল্লিখিত হাদীসের দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই শ্রেষ্ঠ কাফেলার শ্রেষ্ঠরা জীবন ধারণের জন্য রুজির পথ বেছে নিয়েছেন। এর পাশাপাশি এটাও পষ্ট হয়ে উঠলো যে, তারা সবাই স্বহস্তে উপার্জন করতেন। আজকের বিলাসপ্রিয় দুনিয়ায় স্বহস্তে কর্মের কর্মী হতে চায় না কেউ। এবং স্বহস্তে কর্মকে সম্মানের চোখে দেখে না কেউ। কৃষি, দর্জি, ধোপা, রিক্সা ভ্যানচালককে নীচু শ্রেণির কর্মচারী মনে করা হয়।

ঘুষ, সুদ, কালোবাজারী আর নষ্ট ব্যবসায় গড়ে উঠা এসি করা ভিআইপি রুমের স্ট্যান্টার্স চেয়ারে বসাকে সম্মানের জীবিকা অর্জন মনে করে। সার সার ভাবের এক হীনম্মন্যতা স্বহস্ত কর্মকে ছোট করে তুলছে আমাদের সমাজের চোখে। অথচ জীবিকা হালালের নিরাপত্তা ও গ্যারান্টি নিজ হাতের কামাইয়ের মাঝে সবচে বেশি। হুইল চেয়ারে বসে অপরের ফাইল সই করার মাঝে এতোটা হালালের নিরাপত্তা নেই।

 

যে জন রোদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রিক্সার প্যান্টেল চাপে, চাপের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সবকটি জোড়ায় চাপের প্রভাব পরে। কিংবা গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে মাথার উপরে সূর্যতাপের প্রতাপে কৃষক যখন তার খেতে বীজ বুনন করে তার ফলিত ফলে জীবিকা নির্বাহ নিরাপদ ও হালালের গ্যারান্টি রয়েছে সর্বাদিক।

জীবিকা উপার্জনের সহজ সরল ও নির্ভেজাল পথ নিজ হাতে কিছু করা। এর বাস্তব ও জ্বলন্ত উদাহরণ পাবো মানব কাফেলার মহামানবদের জীবন চরিতে। হাদীস শাস্ত্রের মানিত ও বরিত ইমাম আল্লামা নববী (রহ.) বুখারীর সূত্রে বর্ণনা করেন-

عن خالد بن معدان عن المقدام رضي الله عنه : عن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال ( ما أكل أحد طعاما قط خيرا من أن يأكل من عمل يده وإن نبي الله داود عليه السلام كان يأكل من عمل يده

হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন; জগতের কোনো মানুষ কখনোই স্বহস্তে অর্জিত খাদ্যের চাইতে উত্তম কোন খানা খায়নি। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হতে উপার্জিত খাবার খেতেন। (রিয়াসুস সালেহিন, হাদীস ৫৪৩)

 

হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হজরত মিকদাদ ইবনে মাদিকারাবার (রহ.) সূত্রে। সমাজে যারা নিজ হতে অর্জন করতে স্বতঃস্ফূর্ততা পান না বা ভালো মনে করেনা না তাদের জন্য উল্লিখিত হাদীসটির আরো স্পষ্ট বর্ণনা তুলে ধরছি। হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু হতে বুখারী বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন; হজরত দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতের উপার্জন ছাড়া খানা খেতেন না।

হাদিসটি হলো, عن أبو هريرة : عن رسول الله صلى الله عليه و سلم أن داود عليه السلام كان لا يأكل إلا من عمل يده

(রিয়াসুস সালেহিন. হাদিস ৫৪১)।

হাদীসদ্বয়ের জোরালো শ্লোগান হলো নিজ হাতের উপার্জন সবচে’ দামি উপার্জন। একজন পয়গম্বরের জীবিকাহিনী হলো নিজ হাতের উপার্জন।

বর্ণিত তিনটি হাদীস থেকে আমরা জীবিকার যে নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি তা হলো হালাল জীবিকার অন্যতম হলো স্বহস্তের ‘কামাই’। স্বহস্তে উপার্জনের আরেকটি উদাহরণ দিই। আমাদের নিকট অতীতের। আমাদের জানা ইতিহাসের। ভারতবর্ষের বিশাল স্থান যার ইতিহাস ইতিবৃত্ত ব্যাপৃত। তিনি হলেন বাদশা আলমগীর। ভারতবর্ষের পূর্বপশ্চিম যার বাদশাহিতে প্রকম্পমান। এতো বড় বাদশা হবার পরও নিজ হতে উপার্জন করতেন। টুপি সেলাই, টুপি তৈরি ও কোরআন শরীফের নুসখা নির্মাণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

রাষ্ট্রের বাইতুল মাল হতে তার নির্দিষ্ট এবং যথেষ্ট পরিমাণ ভাতা থাকা সত্তেও নিজ হাতের কামাইকে ভাতার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এর কারণ তালাশে যদি নামি তাহলে দেখবো এর মাত্র একটি কারণ দিবালোকের ন্যায় আলোকময় আর তাহলো হালাল ও নিরাপদ রুজির একমাত্র গ্যারান্টি স্বহস্তে উপার্জন। ইতিহাস ও গল্পের বইয়ে বাদশাহ নাসিরুদ্দিনকে জেনেছি, তিনিও বাদশাহীর সঙ্গে সঙ্গে নিজ হাতে টুপি তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করতেন। এভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনিও ভারতবর্ষের বাদশা ছিলেন। ভিনদেশের গল্প নয় আমাদের বাস্তব ইতিহাসের হীরকখণ্ড।

এভাবে উল্লেখ করলে দেখা যাবে আমাদের ইতিহাসের মহারথীরাও নিজ হাতের উপার্জনকে জীবিকার নীতিমালা হিসাবে গ্রহণ করেছে। এ ইতিহাস থেকে বাদ পড়বেনা ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) ইমাম কুদুরির (রহ.) মতো মহামনীষীরাও। দ্যোতিত ও দীপিত জীবনের পাথেয় হলো হালাল উপার্জন। হালাল উপার্জনের মাঝে নির্ভেজাল উপার্জন হলো স্বহস্তে উপার্জন।

 

হাদীস শাস্ত্রের শাইখাইনখ্যাত দুই মহীরুহ ইমাম বুখারী (রহ.) ও মুসলিম (রহ.) এর অভিযোগ হলো হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু এতো হাদীস বর্ণনা করে কীভাবে? মুহাজির আনসার সাহাবিদের কী হলো তারা বর্ণনা করে না কেন? এমন রটনায় মদীনা যখন সারগরম তখন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) আর মুখ বুজে বসে থাকেননি। মুখ খুললেন জনসম্মুখে অধিক হাদীস বর্ণনার কারণ তুলে ধরে জনতার সামনে। বন্ধ করে দেন কানাঘোষা। বলে আমার আনসার ভাই জমিনে কৃষি কাজে ব্যস্ত থাকতো, আর মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে ব্যবসার কাজে মগ্ন থাকতো। আমি আবু হুরায়রা পেটের ক্ষুধার ওপর নবীর মজলিস প্রাধান্য দিতাম। জঠর জ্বালা সয়ে আসহাবে সুফফাকে প্রাধান্য দিতাম। যার ফলশ্রুতিতে আমি হাদীস বর্ণনায় অধিক সংখ্যা পেয়েছি। আমরা হাদীসে দেখতে পাই আনসারগণ জীবিকা নির্বাহ করতেন কৃষি করে, মুহাজিরগণ জীবিকা নির্বাহ করতেন ব্যবসা করে।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের মানব জাতি হিসাবে যখন সৃষ্টি করেছেন তখন জীবিকা নির্বাহ করতেই হবে। মহিলা হই বা পুরুষ হই। তবে আমাদের মহিলাদের একটু সাহজিয়া আছে। আমরা পুরুষের ওপর বর্তায় উপার্জনের পুরোভার। তাই উপার্জনের পথ হিসাবে ওইপথকেই প্রাধান্য দিবো যা হালাল হবার অধিক নিকটবর্তি। হালাল উপার্জনের গুরুত্ববহ একটি হাদীস তুলে ধরছি। দেখুন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;

عن عبد الله بن مسعود - رضي الله عنه - قال : قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - : " طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة " رواه البيهقي في " شعب الإيمان .

তরজমা : হালাল রুজি তালাশ করা দ্বীনের প্রথম স্তরের ফরজের পর অন্যতম ফরজ। (আলফিয়াতুল হাদীস, কানযুল উম্মাহ)

স্বরণ রাখার মতো বিষয়। হালাল উপার্জনের পথ নির্মাণ ফরজ। সুতরাং উপার্জন যখন হবে স্বহস্তে স্বকর্মে তখন অবশ্যই তা হবে হালাল ও নিরাপদ। আল্লাহ আমাদের উপার্জনের পথকে করুন নির্ভেজাল, কলুষমুক্ত সুগম। হারাম, সন্দেহ শংসয় ব্যতীত স্বচ্ছ হালাল জীবন জীবিকা। রিজিকের প্রশস্ত পথ নয় চাই হালালের পথ ছোট্ট করে হলেও। অট্টলিকার বিলাসিতা নয় কসুর মুক্ত স্বল্পে ধৈর্যের প্রাচুর্য। আল্লাহ আমাদের সহায়ক হোন। আমীন।