মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর

নিউজ ডেস্ক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৫৪ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার

বয়স যখন তেরো, বইয়ের পাতায় দেখেছি আমেররিকার নিউইয়র্ক শহরের বিখ্যাত কিছু স্থাপনার গল্প। স্কুল জীবন থেকেই মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল সেই সব বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো বাস্তবে দেখার। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থাকায় ৩৪ বছর বয়সে এসে সেই সপ্ন বাস্তবে রুপ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বহুবছরের সেই স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে নিউইয়র্ক শহরে। স্বপ্নের নিউইয়র্ক শহর নিয়ে লেখার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম।

আমার চোখে নিউইয়র্ক শহর বিশ্বের অন্যান্য শহরের চাইতে ব্যতিক্রম। শুধু শুধু এ শহরকে সারা পৃথিবীর রাজধানী বলা হয়? তা কিন্তু নয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষই এখানে বসবাস করে। এখানকার মানুষ খুবই বন্ধুসুলভ। স্বপ্নের এই শহরে কেউ আসেন জীবিকার সন্ধানে, কেউবা ঘুরতে কিংবা অফিসিয়াল কাজে। আমার জানা মতে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র নিউইয়র্ক শহরেই প্রায় সব দেশের মানুষ বসবাস করে। একই ছাতার নিচে নানা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও নানা সংস্কৃতির শহর নিউইয়র্কের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হলেও এর বিস্তৃতি অনেক যার অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা খুব কঠিন। তবে এককথায় এখানকার মানুষের আচরণ খুবই বন্ধুসুলভ। এখানকার মানুষের কাছে কোন তথ্য চাইলে সেটা দেওয়ার জন্য এতটাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে তা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আর যে কোন উপকার করতে পারলেই নিজেকে খুব ধন্য মনে করে। বিনিময়ে চায় শুধু ধন্যবাদ নামের শব্দটা। ধন্যবাদ, স্বাগতম, আপনার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল এমন তিনটা শব্দ এদের নিত্যদিনের সঙ্গি। আবার নিউইয়র্ক শহরের আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল। পুলিশি সহায়তা, শহরকে নিরাপদ রাখতে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানা নিয়মানুবর্তীতা এ শহরে না আসলে কখনোই উপলব্ধি হতো না।

আবার নিউইয়র্ক শহর নানা ছদ্মনামেও পরিচিত যার মধ্যে একটি হলো নিউইয়র্ক শহর কখনোই ঘুমায় না! আসলেই তাই! এখানকার মানুষের ব্যস্ততা সত্যিই প্রশংসনীয়। সবচাইতে বড় কারণ হলো নিউইয়র্কের সাবওয়ে সিস্টেম আমার কাছে একটি গোলকধাঁধা। যে কেউ ইচ্ছা করলে রাত দুইটা, তিনটা, চারটা অথবা যখন খুশি বাইরে যেতে পারেন এবং বাড়িতে ফিরতে পারেন। আরেকটি অন্যতম কারণ হতে পারে নিউইয়র্কের অলিগলিতে প্রচুর ক্যাফে, দোকান, ওষুধের দোকান, রেস্তোরাঁ রয়েছে যা সারা রাত খোলা থাকে। সপ্তাহে ৫ দিন কাজের চাপে কারোই দম ফেলার সুযোগ নেই। তবে সাপ্তাহিক ছুটিসহ যেকোন ছুটির দিনগুলো তারা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করে। যার ফলে পুরো সপ্তাহের সব ক্লান্তি ভুলে যায়। বাংলাদেশ থেকে আসা সবাই এখন আমেরিকার পরিবেশে-সংস্কৃতির সাথে অনেকটাই মিশে গেছে।

নিউইয়র্কে আবহাওয়ার কোন গ্যারান্টি নাই। রাতে ঘুমের সময় আবহাওয়া একরকম দেখলেও সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় এখানের আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়। তাই প্রতিমূহুর্তে আবহাওয়ার পুর্বাভাস দেখা এখানকার মানুষের নিত্যদিনের রুটিন। আবহাওয়ার উপর নির্ভর করেই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।

নিউইয়র্ক শহরের বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ
নিউইয়র্ক শহরটিতে বহুসংখ্যক আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকা রয়েছে এবং এগুলিকে প্রশাসনিকভাবে পাঁচটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে; যথা- ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, দ্য ব্রংক্স, কুইন্স এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, যাদের প্রতিটিরই নিজস্ব জীবনধারা রয়েছে। তবে সবচাইতে আনন্দের বিষয় হচ্ছে নিউইয়র্কের এসব অঞ্চলের জ্যাকশন হাইটস, ব্রুকুলিন, জামাইকা ও ব্রঞ্জসহ কয়েকটি এলকা ঘুরে মনে হচ্ছে আমিরিকার বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ। বিশেষ করে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডের জায়গাটি বাঙালি কমিউনিটির মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত। নিউইয়র্কে যতদিন ছিলাম বেশিরভাগ সময়টিতেই এ জায়গাটিতে কেটেছিল। ব্রুকলিনে বৃহত্তম কমিউনিটি হচ্ছে সন্দ্বীপের মানুষ। প্রতি বছরই এখানে বাঙালি কমিউনিটির সর্ববৃহৎ পথ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক কমিউনিটির এ পথ মেলায় এসে এত বাঙালি একই ছাতার নিচে দেখে মনে হয়নি যে আমেরিকার মাটিতে রয়েছি। এখানে এসে জানতে পারি ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডের জায়গাটি লিটল বাংলাদেশে বাঙালি কমিউনিটির জন্য নতুন একটি প্লাজা। এই প্লাজা বাঙালি কমিউনিটির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখানে যেকোনো মিলনমেলা, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করা যাবে। এখানে যেকোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে বাঙালি কমিউনিটি। বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি মার্কিন সরকারের বিশেষ আন্তরিকতার প্রাপ্তি এই প্লাজা। অপরদিকে নিউইয়র্কের কয়েকটি রাস্তার নামকরণ বাংলাদেশ স্ট্রিট দেখে নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে খুব গর্ববোধ করেছি। অধিকাংশ দোকান-হোটেল রোস্তোরাগুলোর সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা একই সঙ্গে এসব এলাকায় আড্ডা মারলে মনে হয় সত্যিই আমি বাংলাদেশে আছি।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সক্রিয় অংশগ্রহণ
আমার জানা মতে আমেরিকার প্রায় অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সিটি কাউন্সিল, কাউন্টি পর্যায়ে বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের নানা অনুষ্ঠানে ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান দুই দলের রাজনীতিকরা আসেন এসব বাংলাদেশিদের অভিনন্দন জানাতে। নিউইয়র্কে শুধুমাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নয় এখানকার বাঙালিরা নানা পেশায় অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। বিশেষ করে, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবি ও পুলিশ বাহিনীতে অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত রয়েছে। অত্যন্ত সুনামের সাথে তারা দায়িত্ব পালন করে বিভিন্ন সময় নিউইয়র্কে প্রশংসিত হয়েছেন। একইসঙ্গে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমেরিকার মাটিতে এসে প্রতিনিধিত্ব করছে তা শুনলে সত্যি নিজেকে খুব ধন্য মনে হয়। এদের প্রত্যেকে আমাদের মাথার মুকুট। এরাই হলো আমাদের বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর।

নিউইয়র্কের বাঙালিদের ভালো মুহুর্ত
নিউইয়র্ক শহরে এসে যখন নিজ দেশের মানুষের ভালো লাগার মুহুর্তগুলো শুনি তখন নিজেও এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুভূতি জাগে। এখানকার মানুষ প্রাথমিকভাবে এসে নানা কষ্ট অনুভব করলেও একটা সময়ে চাকুরী, ব্যবসায়-বাণিজ্য করে পরিবার পরিজন নিয়ে খুব আনন্দে দিন পার করে। কেউ ডিভি লটারির মাধ্যমে বা চাকুরী সূত্রে কেউবা ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসার পর প্রথম কয়দিন পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের মিস করে। কিন্তু নিউইয়র্ক শহরে পাড়ি জমানোর পর একটা সময় নিউইয়র্কের কৃষ্টি-কালচারের সাথে মিশে যায়। এরপর একে একে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছে। কোন পরিবারের সব ভাই-বোন, বাবা-মা ও তার নির্ভরশীল সব পরিবারের সদস্য নিয়ে আসার গল্পও শুনেছি। নিউইয়র্ক শহরে কেন ভালো লাগে এমন প্রশ্ন করলে প্রথমেই সবার উত্তর এখানকার চিকিৎসা সেবা সম্পুর্ণ ফ্রি এবং উন্নত। একই সাথে বাচ্চাদের পড়াশোনা এবং বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্য রয়েছে সরকারের বিশেষ সুবিধা। নিউইয়র্ক শহের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব প্রশংসনীয়। জাতিসংঘের প্রেগ্রামের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি কয়েক স্তরের নিরাপত্তার চাদর দিয়ে ঢাকা হয়েছে প্রিয় শহরকে। এ শহরের আইন-কানুন সবার জন্য সমান।এখানকার ধনী-গরীবের মূল্যায়ন আলাদা করে দেখা হয় না। নিউইয়র্কে মানুষের শ্রমের মর্যদার সবার জন্য সমান। এসব নানা কারণে নিউইয়র্ক শহরের প্রত্যেকটা মূহূর্ত আমার কাছে অসাধারণ।

এ শহরের প্রবাসীদের কষ্টের মুহুর্ত
স্বপ্নের শহর নিউইয়র্কে কারো মুখে সুখের হাসির পাশাপাশি নানা কষ্টের মূহুর্তগুলোও শেয়ার করার অনুভূতি গ্রহণ করেছি। উন্নত জীবনের খোঁজে দেশটিতে পাড়ি জমিয়ে কেউ বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। কেউবা বাবা মায়ের মৃত লাশের জানাযায় অংশ নিতে পারেননি। কেউ চলমান মামলার কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন বছরের পর বছর। কেউ বা ২/৩ বছরের রেখে আসা ছোট সন্তানের বিয়ের দৃশ্য দেখেছেন অনলাইনে। এখানে সবাই কাজকে প্রধান্য দেয় আবার এসব কাজ করতে গিয়ে অনেকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও শেয়ার করেছেন। আবার কেউবা নিজ পরিবার নিয়ে এমেরিকায় এসে সংসার জীবনের নানা অশান্তিতেও রয়েছেন। সংসার জীবনে কেউ স্বামী কেউবা স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ করে নানা হতাশায় দিন পার করছেন।

অন্যদিকে নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও স্থিতিশীল জীবনের জন্য নিউইয়র্ক আসেন বেশির ভাগ অভিবাসী। দক্ষিণ আমেরিকা ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসছেন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এদের সামাল দেওয়া নিউইয়র্ক সিটি কতৃপক্ষের এত সহজ কাজ নয়। এত লোক কোথায় রাখবে, তা নিয়েই এখন হিমশিত খেতে হয়। আর এ কারণেই নিউইয়র্কের জীবন-জাপনের স্বপ্ন এখন দিবাস্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা।

কেন আসতে হবে নিউইয়র্ক শহরে?
আপনি যদি ভ্রমণপিয়াসু হয়ে থাকেন, বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সকল জায়গা ঘুরে দেখতে চান, তাহলে নিউ ইয়র্ককে আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখতেই হবে। অনেকগুলো কারণ আপনার সামনে হাজির করা সম্ভব, যেগুলোর জন্য জীবনে অন্তত একবার হলেও নিউ ইয়র্কে আপনার পা রাখা উচিত। বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলির মধ্যে একটি, নিউ ইয়র্ক ("দ্য বিগ অ্যাপল", "এনওয়াইসি," হিসাবে পরিচিত এবং প্রায়শই "নিউইয়র্ক সিটি" নামে পরিচিত)। নিউইয়র্ক শহর মিডিয়া, বিনোদন, শিল্প, ফ্যাশন, গবেষণা, অর্থ, এবং ব্যবসায়ের একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র।

জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত, যা এটিকে আন্তর্জাতিক কুটনীতির জন্য একটি তীর্থস্থান করে তোলে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চিত্র হিসেবে পরিচিত স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, নিউইয়র্ক শহরেই অবস্থিত। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র এটিও নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটান এলাকায় অবস্থিত যা ৭টি ভবনের একটি স্থাপনা।
নিউইয়র্কের পাঁচটি প্রশাসনিক অংশ যথা- ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, কুইন্স, দ্য ব্রঙ্কস এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড। আমার চোখে নিজ নিজ জায়গা থেকে এরা সকলেই অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ব্রঙ্কসে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা, কুইন্সে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক জাতিগোষ্ঠীর রেস্তোরাঁ, ব্রুকলিনের উইলিয়ামসবার্গ, গ্রিন পয়েন্ট ও রেড হুকে অসাধারণ সব বাড়িঘর, এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে ফেরি ছাড়াও আছে স্নাগ হার্বারের জাদুঘর।

এছাড়াও নিউইয়র্কে বেশ কয়েকটি জায়গা আছে যা অবশ্যই আপনার ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তুলবে যার মধ্যে অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, মেট্রোপলিটন যাদুঘর শিল্প, টাইম স্কয়ার, ব্রুকলিন সেতু, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি বেশ উল্লেখযোগ্য।

স্ট্যাচু অব লিবার্টি সম্পর্কে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। প্রায় দেড়শ বছর ধরে আমেরিকার সাম্য আর মুক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি। আমেরিকার স্বাধীনতার ১০০ বছর উপলক্ষে, ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি আমেরিকার জনগণকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এটি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চিত্র। এই বিখ্যাত নিউইয়র্ক স্থানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স দ্বারা যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং দুটি দেশের জনগণের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ককে সম্মান করার উদ্দেশ্যে ছিল। একটি চমৎকার এবং অপ্রতিরোধ্য অভিজ্ঞতা, স্ট্যাচু অব লিবার্টির চূড়ায় আরোহণ করা বন্দর, ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, ভেরাজানো ব্রিজ এবং স্টেটেন দ্বীপের দৃশ্য দেখায়। মূর্তি ভর্তি লিবার্টি মিউজিয়াম বিনামূল্যে দেখতে পাবেন এবং এটি লিবার্টি দ্বীপে। কেউ ব্যাক্তিগতভাবে যেতে চাইলে কম খরচে ফেরি দিয়ে কিংবা ম্যানহাটন থেকে কেউ যেতে চাইলে সেখানকার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অনেকেই একটি নির্দিষ্ট প্যাকেজে এই ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানটিতে ঘুরে আসতে পারেন।

বিভিন্ন বই আর সিনেমায় দেখা নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী ভবনগুলো সবারই কম-বেশি জানা। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ভবনগুলো। ম্যানহাটন স্ট্রিট ধরে হেঁটে যাওয়ার মতো অসাধারণ অনুভূতি খুব কমই পাওয়া যায়। কেননা এই সড়কজুড়ে আকাশচুম্বী সব ভবনের সম্ভার। ১৯৩০-এর দশকের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ক্রাইসলার বিল্ডিং যেমন আছে, তেমনই আছে ২০১৩ সালে কাজ শেষ হওয়া ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারও। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের উপর থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা দর্শকের নিঃশ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে দিতে যথেষ্ট। এমন অনেক উঁচু ভবনের চূড়ায় উঠে নিউইয়র্ক শহরকে দেখলে মনে হবে কোন এক শিল্পীর রঙে আঁকা এই শহর।

নিউইয়র্ককে বলা হয়ে থাকে ভোজন রসিকদের স্বর্গ। এই শহরের অলিগলিতে রয়েছে হাজারো রেঁস্তোরা। একেক রেঁস্তোরায় একেক রকমের খাবারের পশরা। বিশ্বের সব দেশের বিখ্যাত খাবার খেতে পারবেন এখানে। পাওয়া যায় দেশ বিদেশের শত শত কুইজিন। বাবুর্চিরা সবসময়ই নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করে চলেছেন। লোভনীয় এসব খাবারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও যেন কষ্টকর মনে হয় না।

যারা গানপিপাশু বিশেষ করে রেকর্ডেড গানের চেয়ে লাইভ গানের প্রতি বেশি অনুরাগী, তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে নিউ ইয়র্কে সপ্তাহের সাতদিনই বসে শীর্ষস্থানীয় শিল্পী ও ব্যান্ডগুলোর লাইভ গানের আসর। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন কিংবা ব্রুকলিনের বারক্লেস সেন্টার তো আছেই, এছাড়া রেডিও সিটি মিউজিক হক, বেকন থিয়েটার, আরভিং প্লাজা, হ্যামারস্টেইন বলরুম, ওয়েবস্টার হল, উইলিয়ামসবার্গের ব্রুকলিন স্টিল কিংবা ফ্ল্যাটবাশের কিংস থিয়েটারেও প্রায়ই জমে গানের জম্পেশ সব আয়োজন।

নিউইয়র্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো দেখতে কিংবা ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাহলে সেন্ট্রাল পার্কের মতো দারুণ জায়গা খুব কমই খুঁজে পাবেন। ম্যানহাটনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই পার্কে আছে জন লেননের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ স্ট্রবেরি ফিল্ডস, আছে লুই ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, আর পার্কের প্রাণকেন্দ্রে আছে বেথেসডা ফাউন্টেন অ্যান্ড টেরেসও। ১৮৫৮ সালে চালু হওয়া এই পার্কের নকশা তৈরি করেছিলেন ফ্রেডেরিক ল ওমস্টিড এবং কালভার্ট ভো। তারা ১৮৬৭ সালে চালু হওয়া ব্রুকলিনে প্রসপেক্ট পার্কেরও নকশা করেছিলেন। দুটি পার্কেই আছে চিড়িয়াখানা, হ্রদ, হাজার হাজার সবুজ গাছ, আর অনন্য চারণভূমি। দর্শনার্থীরা চাইলে এই পার্ক দুটিতে এসে স্কেটিং করতে পারেন কিংবা হকিও খেলতে পারেন। তবে ছবি তোলার জন্য সেন্ট্রাল পার্কের চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না। 

নিউইয়র্ক গিয়ে সবাই সবার আগে যে জায়গাটা ঘুরতে যায় সেটা হচ্ছে টাইমস স্কয়ার। হলিউড বা বলিউড মুভিতে এই জায়গাটি দেখা যায় হরহামেশাই। জায়গাটি সবসময়ই লোকে লোকারণ্য থাকে। পর্যটকরা নিউ ইয়র্ক এসে এই জায়গাতেই ভীড় করে সবচেয়ে বেশি। এটি মূলত ৪ রাস্তার মোড়ে একটি চত্ত্বর যেটির আশেপাশের বহুতল দালানের দেয়ালে বিশাল বিশাল সাইজের অসংখ্য বিলবোর্ড ঝোলানো আছে। বিলবোর্ডগুলোতে সারা বছরজুড়ে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। টাইমস স্কয়ার এ রাস্তার ওপর নানানরকম বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকে স্থানীয় এন্টারটেইনাররা। পর্যটনকে বাঁচিয়ে রাখতে গান, নাচ, মূকাভিনয়, ইত্যাদিতে মাতিয়ে রাখে পর্যটকদের। আমার জানা মতে টাইমস স্কয়ারের সাজসজ্জা সবচেয়ে সুন্দর লাগে নতুন বছর উদযাপনের সময়, যদিও সরাসরি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। নতুন বছর শুরু হয় বিখ্যাত “বল ড্রপ” ইভেন্ট দিয়ে। এছাড়াও নাকি ক্রিসমাস ও অন্যান্য বিশেষ দিনেও টাইমস স্কয়ার সাজে অপরুপ সাজে। আর বছরের যে কোন দিন রাত ১২টায় বিলবোর্ডগুলোতে প্রদর্শিত হয় মডার্ন পেইন্টিং ও আর্ট। টাইম স্কয়ারের এমন অপরুপ দৃশ্য আপনাকে নিউইয়র্কে নিয়ে আসতে বাধ্য করবে।

যদিও একেক জনের চোখে নিউইয়র্ক শহরের অনুভূতি একেক রকম হলেও আমার চোখে রাতের নিউইয়র্ক শহর সত্যিই মনোমুগ্ধকর। রাতের মনোরম নগরী দেখার অনুভূতি একেক রকম। বিশেষ করে রাতের ম্যানহাটন কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলগুলো ঘুরে যাই দেখি তা কেন যেন ক্যামেরায় ধারণ করতে পারছি না। অর্থাৎ চোখ দিয়ে যা দেখি তা ক্যামেরায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।

যদি সত্যিকারের ভ্রমণপিয়াসু হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই একটিবারের জন্য ঘুরে আসুন স্বপ্নের শহর নিউইয়র্ক।

লেখক : শাহীন হাওলাদার
সাংবাদিক, স্থায়ী সদস্য ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।