‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিষেধাজ্ঞা’র রাজনৈতিক অর্থনীতি
নিউজ ডেস্ক
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:৩৩ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে বিভিন্ন কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। তবে কোন কারণে সে সম্পর্কে ফাটল দেখা দিলে অপর পক্ষের উপর নেমে আসে বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা।
বিশ্বের নানা দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রায়ই তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চোখে পরে। কখনও তা পরিচালিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অথবা সেই নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ কার্যালয় থেকে।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ফাটলও ততো দৃশ্যমান হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা এ বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলো। যে প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপোষহীন সংলাপের আহ্বানও ছিলো।
তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিধান্তে অটল থাকায় দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের প্রার্থীদের কোন মনোনয়ন পত্র দাখিল না করায় নির্বাচনকে ঘিরে দেখা যাচ্ছে নানা ধরণের শঙ্কা । আবারও কি একটি একপেশে নির্বাচন দেখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ? গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে কীভাবে বাংলাদেশ অভন্ত্যরীন ও আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহি করবে? কিংবা তার ফলাফল-ই বা কী হতে পারে?
দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের সমঝোতায় শক্তিশালী রাষ্ট্র, অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর প্রাথমিকভাবে যে পদ্ধতি গ্রহণ করে তা হচ্ছে নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ। প্রথমে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, তাদের সহায়তাকারী সরকারি কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপর সেই নিষেধাজ্ঞা আসলেও পরবর্তীতে ধাপে ধাপে তা সারা দেশের মানুষের উপরেই আরোপিত হয়।
১০ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’ (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ তাদের পেজ-এ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়। তবে ঠিক কতজন এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে সে সংখ্যাটি না জানালেও, বলা হয় ভবিষ্যতে কারও বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানের প্রমাণ পেলে তারাও অন্তর্ভুক্ত হবেন ভিসা নিষেধাজ্ঞার।
দ্বিতীয় ধাপে আরোপিত হতে পারে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার এখনও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের কোন কঠোর সিদ্ধান্তের প্রভাব তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর পড়বে না, এমনটা বিশ্বাস করা অমূলক।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে, যার বেশিরভাগই ছিল পোশাক বস্ত্র ও তৈরি পোশাক। যা মোট রপ্তানি আয়ের ১৯.০২ শতাংশ। একই অবস্থা বিরাজ করছে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এর ক্ষেত্রেও। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৮২৩ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ তিন দশমিক ৯৪৮ বিলিয়ন ডলার। যা মোট এফডিআই এর ১৮.০৯ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি প্রবাসী আয়েরও একটি বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সর্বশেষ ১৬ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন শ্রম আইনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে তাদের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা সহ নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সেই নিষেধাজ্ঞায় রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা নেই বললেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে এসেছে নির্বাচনকে ঘিরে পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে তার পশ্চিমা মিত্র কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর অন্যান্য দেশও তাদের পথে হাটলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতির তৈরি হবে। কূটনীতির সেই চালে বাংলাদেশের সফল হওয়ার সম্ভাবনাও তখন অনেকাংশে কমে আসবে।
লেখক: শাফাআত হিমেল
সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক