শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন বছর, কেন?

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৭:৫৬ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার


মনজুর আহমদ
কালের যাত্রার পথে আমরা আরো একটি বছর অতিক্রমণের প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। আর দুদিন পরই বিদায় নেবে ২০২৩ সাল। উদয় হবে ২০২৪ সালের নতুন সূর্য। নতুন দিন, নতুন সূর্য, কিন্তু কি নতুন বারতা নিয়ে আসছে নতুন বছরটি? চিরায়ত রীতি অনুযায়ী বছর শেষের এই দিনগুলি আমাদের হিসাব মেলাবার সময়। পেছনে ফেলে আসা বছরে কি পেলাম কিংবা পেলাম না, আর আগামী বছরে কি পেতে যাচ্ছি বা কি আমাদের প্রত্যাশা।
বলতে দ্বিধা নেই, এই সালতামামি আমাদের যতটা বিষন্ন করে ততটা আনন্দিত করে না। পেছনে ফেলে আসা বছরটি যত না হয় আনন্দের তার চেয়ে বেশি হয় বিষাদের। বরাবরের মতো ২০২৩ সালটির সাথেও জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেক দুঃখ, অনেক বেদনা। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছাড়া আর কোন অর্জন এ বছর মানবজাতির সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। বছর শেষের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার গণহত্যা। মানবতাবাদী বিশ্ব এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপই নিতে পারল না। জাতিসংঘের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ সব ব্যর্থ হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে সবাই হাত গুটিয়ে নিল।
‘সান্তা ক্লজ, এবার তুমি গাজায় যেও না। সেখানে কোন শিশু জীবিত নেই।’ বেথেলহেম ইভানজেলিক্যাল লুথারান চার্চে যীশুর প্রতীক একটি পুতুলকে ব্যান্ডেজ বেঁধে ফিলিস্তিনি স্কার্ফে মুড়ে রেখে দেয়া হয়েছে বোমা বিধ্বস্ত একটি ভবনের কংক্রিটের ধ্বংসস্তুপে। সেখানে লিখে দেয়া হয়েছে ‘টেল সান্তা ক্লজ হি ডাজ নট নীড টু ভিজিট গাজা! দেয়ার আর নট এনি চিলড্রেন লেফট’।  এএফপি’র এই ছবি দেখে চোখের পানি সংবরণ করা যায় না। নিঃসন্দেহে এই ছবিই প্রতীক হয়ে রইল ২০২৩ সালের নির্মমতার।
এ বছরেও সমাধান হলো না বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যার। বন্ধ হলো না মিয়ানমার সামরিক জান্তার অগণতান্ত্রিক সামরিক একনায়কতন্ত্রের দুঃশাসনের, সেখানকার ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞের। প্যালেস্টাইনের মতো এই ইস্যুতেও বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি বিভক্ত। যে যার স্বার্থে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেদের লক্ষ্যপথ। এ বছরও বন্ধ হলো না ইউক্রেন যুদ্ধ। বৃহৎ শক্তিধরেরা এই যুদ্ধ থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া। মানবতা এখানে ভূলুন্ঠিত। নারী-শিশুর আর্তনাদের প্রতি কারো ভ্রƒক্ষেপ নেই। যেমন নেই প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে। হিংসায় উন্মত্ত এই পৃথিবীতে বৃহৎ শক্তিগুলি সবাই নিজেদেরকে আপন স্বার্থের বলয়ে আবদ্ধ করে রেখেছে।  
পৃথিবী জুড়ে এত সহিংসতা, এত অস্থিরতা, এত অমানবিকতা। এ সবের মধ্যেও আমরা শান্তির প্রয়াসী। পৃথিবী থেকে হিংসার অবসানের স্বপ্ন আমরা অতীতের মতো আগামী দিনেও লালন করে যাব। আমরা বলব, ‘আর হিংসা নয় নয়, আর যুদ্ধ নয় নয়’। নতুন বছরকে আবাহন জানিয়ে আমরা বলব, ‘যাক পুরাতন স্মৃতি’, ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’। হ্যাঁ, পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়। নতুনকে বরণ করে নেয়াই তো মানুষের ধর্ম। আমরা এখন প্রস্তুত নতুন বছরকে বরণ করতে। আমাদের কন্ঠে এখন স্বাগত ধ্বনি। সুস্বাগতম ২০২৪। পুরাতন বছরকে বিদায় জানাতে যেমন বেদনা আছে, নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে তেমনি আছে আনন্দ। টাইমস স্কয়ারে নতুন বছরকে বরণ অনুষ্ঠানে আনন্দের যে হুল্লোড় বয়ে যায় সে আনন্দে একাত্ম হয়ে আমরাও সোচ্চারে বলতে চাই, শুভ নববর্ষ।
কিন্তু নববর্ষকে শুভ বলতে একরাশ দ্বিধায় আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। সত্যিই কি নতুন বছরটি আমাদের জন্য কোন শুভ সংবাদ বয়ে আনবে? সত্যিই কি বছরটি মঙ্গলময় হবে? বছরের শুরু থেকেই আমরা এক উদ্বেগাকুল সময় কাটাব বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন। বিগত দুটি সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব এ দুটি নির্বাচনকে মেনে নেয়নি। তারা উৎকন্ঠিত এবারের নির্বাচন নিয়েও। উৎকন্ঠার কারণও রয়েছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে পুরোপুরি কারারুদ্ধ করে রেখে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা সম্পূর্ণতই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিজেদের নির্বাচন। নিজেদের নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে নিজেদের দলেরই মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ এক অভিনব নির্বাচন। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী কৌশলে মনোনয়ন বঞ্চিত দলীয় প্রার্থীদের আর বিদ্রোহী বলা হচ্ছে না, কিংবা দল থেকে তাদের বহিষ্কারও করা হচ্ছে না। এবার তাদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এই নির্বাচনী কৌশলে যেই জিতবে সেই আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি-কে ছেড়ে দেয়া ৩২টি আসনে নৌকা প্রতীকে যারা নির্বাচন করছে তারও আওয়ামী লীগের শরিক। অর্থাৎ বিজয়ী সব সদস্যই হবেন আওয়ামী লীগের। বিগত দুই সংসদের মতো এবারের সংসদও হবে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্যের। প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন এভাবেই হয়ে যাবে কিন্তু এর পর? এরপর কি হয় তা দেখতেই এখন আমাদের উৎকন্ঠিত প্রতীক্ষা।
কি হবে এ বছর প্যালেস্টাইন সমস্যার? গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান নিয়ে কেউ কি এগিয়ে আসবে? বন্ধ হবে কি গাজায় ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ? ফিলিস্তিনিরা কি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? শান্তিকামী বিশ্বের দাবী অনুযায়ী সেখানে কি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হবে?  
যুক্তরাষ্ট্র বছরের শুরুতেই সম্মুখীন হচ্ছে বড় ধরনের উদ্বাস্তু সমস্যার। গত বছরের পুরোটা জুড়েই এ সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। এখন তা আরো প্রকট রূপ নিতে চলেছে। মেক্সিকো সীমান্ত অভিমুখে এখন রয়েছে প্রায় ৫ লাখ মানুষের ঢল। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি থেকে দলে দলে অভিবাসন প্রার্থীরা আসছে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে। এ সমস্যা সামাল দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনী ব্লিংকেন ছুটে গেছেন মেক্সিকোতে। এ সমস্যা মোকাবিলা নিয়ে কথা বলেছেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে এবার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা। উৎকন্ঠা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে। তিনি অনেক আগেই তার প্রার্থিতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ক্যাপটিলে হামলা সহ বিভিন্ন অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন ট্রাম্প কি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা রাখেন? আমেরিকার ইতিহাসে ট্রাম্পই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। রিপারিকান প্রাইমারিতে অংশ না নেয়া সত্ত্বেও কি তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন? পুরো চিত্রটি দৃশ্যমান হতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে এ দেশের মানুষকে।
সব মিলিয়ে নতুন বছর আমাদের জন্য কি উপহারের ডালি সাজিয়ে আনছে তা দেখার অপেক্ষাতেই আমরা রইলাম।