বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

ভিন্ন ভাষাভাষীদের আগ্রহ নেই

হাসানুজ্জামান সাকী

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:০৭ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার


বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাড়ম্বরে উদযাপন

 
একুশে ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে শতাধিক সংগঠন মাতৃভাষা দিবস উপদযাপন করেছে। ছবিটি ব্রঙ্কসে বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস-বাফার সৌজন্যে


অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাষাভাষী ও বৃহৎ অভিবাসী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এই দিনটি সম্পর্কে খুব কমই জানেন। জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত এ দিবসটি দুই যুগ পার হয়ে গেলেও তা যেন কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। যদিও বায়ন্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে যথাযথ মর্যাদার সাথে প্রতিবছর দিবসটি উদযাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অভিবাসী দেশ। নিউইয়র্ক শহর এবং এর মেট্রোপলিটন এলাকা আমেরিকায় অভিবাসনের প্রধান প্রবেশদ্বার। নিউইয়র্কে প্রায় ৮০০টি ভাষা চালু আছে। বিশ্বের ভাষাগতভাবে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় শহর নিউইয়র্ক। কিন্তু কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি ছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে বলা যায় অবগতই নন অন্য ভাষাভাষীর মানুষ।
প্রচলিত আছে, টাইমস স্কয়ারে আপনি যদি কিছুক্ষণ দাঁড়ান, দেখতে পাবেন পুরো বিশ্বের মানুষ এখানে হেঁটে যাচ্ছে। এটা সেই শহর যা কখনও ঘুমায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। কিন্তু তারাও জানেন না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা।
টেক্সাস থেকে নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছেন আলেকজেন্ডার। অপর এক বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন জ্যাকসন হাইটেসের ডাইভারসিটি প্লাজায়। তিনি জানেন, এই এলাকায় বহু ভাষাভাষীদের বসবাস। তিনি এও জানেন যে, এখানে ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশি কমিউনিটির বাসিন্দা বেশি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানেন? আজকালকে আলেকজেন্ডার বলেন, তিনি এই দিবসটি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ইংরেজিতে তিনি বলেন, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া এবাউট ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে। আই নেভার হার্ড ইট বিফোর। হোয়াট ইজ দ্যাট।’
একই ভাবে আরও চার বন্ধু- অ্যালেক্স, রোমানিয়া, সিলভিয়া ও জন। তারাও হেঁটে যাচ্ছিলেন জ্যাকসন জাইটসের ডাইভার সিটি প্লাজা দিয়ে। তারাও জানালেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। কোনোদিন এ দিবস সম্পর্কে কারও কাছ থেকে কিছু শোনেননি। তবে জন বললেন, তিনি এ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
নেপালি ও তিব্বতিদের বর্ধিত কমিউনিটি এখন জ্যাকসন হাইটস। নেপালি তরুণী সোনিয়া লামা জানালেন, মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তিনি এ দিবস সম্পর্কে কোনোদিন কিছু শোনেননি।
এমনকি ভারতের বাঙালি কয়েকজনকে প্রশ্ন করা হলে তারাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ভারতীয় বাঙালি কয়েকজনকে পাওয়া গেল, তারা দিবসটির কথা শুনেছেন তবে কখনও পালন করেননি। কিংবা কেউ এ দিবসটি উদযাপন করেছেন এমনটিও দেখেননি।
কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশি কমিউনিটি। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা এবারও ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করেছেন। ৩৩ বছর ধরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে বাঙালি চেতনা মঞ্চ ও মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহ্যগত ভাবেই বগু বছর ধরে নিউইয়র্কেও প্রায় সব সংগঠনগুলোকে নিয়ে অমর একুশে পালন করে আসছে। বাংলাদেশ সোসাইটিও একই ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। জাতিসংঘ সদও দপ্তরের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের উদ্যোগে এবারও আন্তর্জাতিক মাতৃখাষা দিবস উদযাপিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। নিউইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছাড়াও এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠনের বিদেশিরা অংশ নেন। তারা বাংলায় সংগীত পরিবেশন করেন। কেউ কেউ নিজ নিজ মাতৃভাষায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন। তারা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে সবাইকে জানানোর কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
এদিকে, বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বের ৭ম বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে সেই দাবিটিও উপেক্ষিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোর এ ব্যাপারে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই।
নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক নাজমুল আহসান বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবব্ধ হয়ে আছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন ও বাংলাদেশ দূতাবাসকেও আরও জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তারা উদ্যোগ নিলে নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও স্থান দেয়া যেতে পারে। আর এটা হলে সব ভাষাভাষী নতুন প্রজন্ম দিবসটি সম্পর্কে জানতে পারবে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মো. আবদুল মুহিত আজকালকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার তাৎপর্য হলো বিভিন্ন ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই ভাষার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ কিংবা ইউনেস্কোর ভূমিকা তো রয়েছেই, তবে এজন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে। আর বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে চালুর জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আর্থিক সংশ্লেষও রয়েছে। এটি কিভাবে সমাধান করা যায় আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করছি।’  
প্রসঙ্গত, বিশ্বের বৃহত্তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। এটি বাংলাদেশে শহীদ দিবস হিসাবেও পরিচিত।