বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে দুর্নীতি
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১৯ এএম, ২৩ মার্চ ২০২৪ শনিবার
আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তা
বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকের টাকা লুটপাটের কারণে এই খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও শোচনীয়। অর্থ পাচারের ঘটনাও বেড়েই চলেছে। দুর্নীতির এসব ঘটনার অনেকটাই ঘটছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর অনেক উদ্যোগ এবং বিদ্যমান আইন কোনওটাই কার্যকর করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় চার লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ খেলাপি হয়ে আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। তার বাইরে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বিভিন্ন মামলায় আটকে আছে। এই অর্থ ঘোষিত খেলাপি ঋণের মধ্যে ধরা হচ্ছে না। ঋণ অবলোপন আছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি হলেও এটা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বিধায় অবলোপন করে এই ঋণের অর্থ ব্যালেন্সশিট থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। খেলাপি ঋণ হওয়ার পরও পুনঃতফশিল করে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকাকে খেলাপি দেখানো হচ্ছে না। এসব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ কোটি টাকার মতো খেলাপি হয়ে আছে।
খেলাপি ঋণের এই নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রায়ই তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে। কারণ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থের প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বিপদগ্রস্থ অবস্থায় পতিত আছে। এই দুর্দশা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। তার মধ্যে চার লাখ কোটি টাকার অনিশ্চিত অবস্থা দুশ্চিন্তার বড় কারণ। এই পরিমাণ অর্থ আদায় হওয়ার লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশে ১৬১টি ব্যাংক আছে। তার মধ্যে ১০/১২টি ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। ২০/২৫টি ব্যাংকের অবস্থা মাঝারি মানের খারাপ। বাংলাদেশের ১০টি ইসলামী ব্যাংকের আটটিই এক ব্যাক্তির অর্থাৎ এস আলমের হাতে। নন-ব্যাংক আর্থিক খাতের ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৫/২০টি দেউলিয়া ঘোষণা করা সম্ভব। এছাড়া, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ভেঙ্গে পড়েছে। পথে বসেছেন লাখো বিনিয়োগকারী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দুর্নীতির কারণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সম্পদ আহরণে ঘাটতির মুখে পড়ে আছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র খুবই নাজুক। বিশেষ করে বর্হিবিশে^ অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাও এই অবস্থার জন্যে কম দায়ী নয়। মূল্যস্ফীতি হু হু করে বাড়ছে।
ব্যাংকিং খাতে সুখবর না থাকার বড় কারণ হলো ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নামে-বেনামে টাকা বের করে নিচ্ছে। কোনও পরিচালক হয়তো তার গাড়িচালকের নামে ঋণ নিচ্ছেন। কিংবা অন্য কোনও কর্মচারির নামে ঋণ নিয়ে সুবিধা ভোগ করছেন পরিচালক নিজে। ব্যাংকের পরিচালকদের ৯০ ভাগের বেশি ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ কারণে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও উদ্যোগই কাজে আসছে না। ব্যাংকিং খাত ভেঙ্গে পড়ার বড় চিত্রটি চোখে পড়েছে সম্প্রতি হঠাৎ করে দু’টি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ দেখার পর। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে পদ্মা ব্যাংক। নতুন নাম হয়েছে এক্সিম ব্যাংক। পদ্মা ব্যাংকের আগের নাম ছিল ফারমার্স ব্যাংক। তখন ব্যাংকটি দুর্নীতির রাহুগ্রাসে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রম হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নাম পরিবর্তন করে তাতে নতুন পুঁজি দিয়ে পদ্মা ব্যাংক নামে নতুন যাত্রা শুরু করে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত একীভূত হয় এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে। কিন্তু একীভূত হয়ে সংকট উত্তরণ সম্ভব কিনা তা নিয়ে রয়ে গেছে যথেষ্ট সংশয়। এছাড়াও, বেসিক ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক প্রভৃতি বেশ কিছু ব্যাংকের অর্থ এতটাই লোপ হয়েছে যে, এগুলোকেও রক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অর্থনীতির চালিকা শক্তি ব্যাংকিং খাতে এখন চলছে রক্তক্ষরণ। মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)-এর তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ থেকে গত পাঁচ বছরে ছয় বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এটা হলো বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের চিত্র। তথ্যের গরমিল দেখিয়ে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। বাণিজ্য ছাড়াও ভিওআইপি, হুন্ডি এবং সরাসরি ডলার নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেও অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। এগুলোর কোনও হিসাব কাজ করার জন্য কারো কাছে নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। এগুলো শিল্প, সেবা ও কৃষি খাত থেকে আসে। তার সঙ্গে রেমিটেন্সও যোগ হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই আকারের মধ্যে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার বিশ^ বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ আমদানি, রফতানি ও রেমিটেন্স বিশ^বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ^বাজারে অবস্থা খারাপ হলে বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বিশ^বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশে^ কোভিড মহামারি, যুদ্ধসহ বৈশি^ক টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব পড়ে। তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ৫৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় বৈশি^ক ঝাঁকুনি অনেক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামাতে পারে না। ২০০৮ সালে বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী অবস্থার কারণে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়ার বড় অবদান প্রবাসী বাংলাদেশীদের। তাদের পাঠানো বার্ষিক ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার সত্যিকার অর্থে বর্হিবিশে^র মুদ্রার সংযোগ। রফতানির মাধ্যমে যা আয় হয় সেটা পণ্য পাঠিয়ে আয় করা হয়। ফলে সেটা রেমিটেন্সের মতো সত্যিকার আয় নয়। বরং রফতানি অনেকটা বিনিময়ের মতো বিষয়। বাংলাদেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কম থাকায় মুল্যস্ফীতির মতো ঘটনাও জনগণকে কষ্ট দিচ্ছে। অর্থনীতির এই শনির দশা কাটাতে সরকার ভবিষ্যতে কী ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ করে সেটিই দেখার বিষয়। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কঠিন।