রোববার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৭ ১৪৩১   ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত ছিল’

ঢাকা প্রতিনিধি

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:২৭ এএম, ২৩ মার্চ ২০২৪ শনিবার

হলমার্কের চেয়ারম্যান এমডির যাবজ্জীবন

 

হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক ঋণ জালিয়াতির এক মামলায় এ কারাদন্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের ৫ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলা মনে করে তাদের মৃত্যুদন্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু যে আইনে মামলা হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
যাবজ্জীবন দন্ডিত অন্য সাত আসামি হলেনÑ তানভীরের ভায়রা ও হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদ, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, সাইফুল হাসান, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও আবদুল মতিন। বর্তমান বিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর।
অপরদিকে রায়ে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবিরসহ (পলাতক) আরও ৭ আসামিকে ৫ বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা হলেনÑসাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার, সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সফিজউদ্দিন এবং এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান। এরমধ্যে জামাল উদ্দিনকে ৫ বছর কারাদন্ড দেন আদালত। সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ বাকি ৭ আসামিকে পৃথক দুই ধারায় ১৭ বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়। মঙ্গলবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক মো. আবুল কাশেম আলোচিত এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার আগে কারাগার থেকে তানভীর ও জেসমিনসহ বন্দি আসামিদের এজলাসে হাজির করা হয়। রায় শোনার পর আধা ঘণ্টা মাথা নিচু করে বসে থাকেন তানভীর ও জেসমিন দম্পতি। তারা নিজেরাও এ সময় কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তানভীরের ভায়রাও ছিলেন নিশ্চুপ।
জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় পৃথক একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা (বর্তমানে রূপসী বাংলা) থেকে ৫২৫ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা ঋণের নামে নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। এতে পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলার তদন্ত করে আসামিদের বিচারের জন্য আদালতে চার্জশিটও দেয় দুদক।
দুদকের তদন্ত সূত্র বলছে, সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার এমডি, ডিএমডিসহ শাখা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেল শাখা থেকে হলমার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১টি মামলায় হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তার ভায়রা তুষার আহমেদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়। পরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই ১১টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বদলি করা হয়। ১১টি মামলার মধ্যে মঙ্গলবার একটি মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। এটিই হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি মামলায় দেওয়া প্রথম কোনো রায়। বাকি ১০ মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১১টি মামলার মধ্যে একটির রায় হয়েছে। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। বাকি যে ১০টি মামলা রয়েছে সেগুলোও একই ধরনের অভিযোগ। সে মামলাগুলোতেও আসামিদের যাবজ্জীবন সাজা হবে আশা করি।
দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, মামলার সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চাওয়া হয়েছিল। আদালত সবকিছু পর্যালোচনা করে রায় দিয়েছেন। তিনি হলমার্কের মতো একটি অস্তিত্বহীন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ তুলে দেওয়ার ঘটনাকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দুর্গতি হিসাবে উল্লেখ করেন। বলেন, এ ধরনের দুর্গতি হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। আইন অনুযায়ী সাজা মৃত্যুদন্ড থাকলে আদালত তাই দিতেন বলে বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে, রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় সঠিক হয়নি। রায়ে ব্যাংকারদের সাজা কম দিয়েছেন বিচারক। অথচ ব্যাংকের বাইরের আসামিদের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টে আপিল করে ন্যায়বিচার পাব আশা করি।