রোববার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৬ ১৪৩১   ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঈদের আগে অশান্ত পাহাড়

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:২৭ এএম, ৬ এপ্রিল ২০২৪ শনিবার

বান্দরবানের পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর প্রশিক্ষণ শিবির থেকে তোলা ছবি : সংগৃহীত

বান্দরবানের পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর প্রশিক্ষণ শিবির থেকে তোলা ছবি : সংগৃহীত


বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কেএনএফ’র তান্ডব

ঈদের আগে উপ্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। বাংলাদেশের বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে তিনটি ব্যাংক লুট হয়েছে। ব্যাংকের একজন ম্যানেজারকে অপহরণ করার পর র‌্যাব তাকে উদ্ধার করেছে। থেমে থেমে গোলাগুলি হচ্ছে বান্দরবানে। কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামের একটি পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী গুলি চালিয়ে জিম্মি করে ত্রাসের রাজত্ব চালায়। তুলনামূলক নতুন এই গ্রুপটি বেশ কিছুদিন যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামের অপেক্ষাকৃত শান্ত বান্দরবান এলাকায় অস্ত্রের মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক লুটের ঘটনার পর যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। দৃশ্যত কেএনএফের সশস্ত্র বাহিনী মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হামলা চালিয়েছে। এই হামলাকে নিছক ডাকাতির ঘটনা বলেও কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এই ঘটনার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যুক্ত আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের একদা গেরিলা নেতা জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তি চুক্তি সই করার পর পাহাড়ি অঞ্চল অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। যদিও শান্তি চুক্তির বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেভেলপমেন্ট ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেএনএফ নামের নতুন গ্রুপটির সশস্ত্র তৎপরতার কারণে পাহাড়ে নতুন করে আশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ঈদের আগে চাঁদাবাজি ও নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে হামলা চালালেও সামনে ঈদ ও বাংলা নববর্ষের ছুটির দিনগুলোতে আরও হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কেএনএফের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানালেও পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মুক্তিপণ দিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে বলে তারা বলছেন। বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও বান্দরবানের থানচির দুর্গম অঞ্চলে গোলাগুলি চলছিল বলে জানা গেছে। যদিও এই গোলাগুলি কাদের মধ্যে হচ্ছে সেটা জানা যায়নি।  
বুধবার বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায় কেএনএফ। ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে। বেশ কয়েকটি বন্দুক নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার তারা তান্ডব চালায় থানচিতে অবস্থিত সোনালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকে। লুট করে অর্থ। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেএনএফ তৎপরতা শুরু করে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে কেএনএফ সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের তথ্যও প্রচার করছে। ফেসবুকে তারা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করেন। কেএনএফের ঘোষণা এবং বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। তাদের দাবি-পাহাড়ের নয়টি উপজেলা তাদের পূর্ব পুরুষদের আদিনিবাস। এসব উপজেলা নিয়ে তারা স্বায়ত্ত্বশাসিত কুকি চিন রাজ্য দাবি করছে। তাদের দাবি, এ রাজ্যে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি এবং ¤্রােরা থাকবে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকতে পারবে না। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে প্রধানত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে। তাদের দাবি, জনসংহতি সমিতিসহ অন্য সংগঠনগুলো তাদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। বিভিন্ন অপরাধ করছে। তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে কেএনএফের সৃষ্টি। সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে। এরপর তারা শতাধিক সক্রিয় সদস্যকে মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মনিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র অবস্থায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের রুমা সীমান্ত এবং ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সংগঠনের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে ছয় শতাধিক সদস্য আছে। বর্তমানে তারা বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার পাঁচটি উপজেলায় ঘাঁটি গেড়েছে।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান সবচেয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির জেলা হিসাবে পরিচিত। তবে গত বছর থেকে কেএনএফের সশস্ত্র কর্মকান্ড শুরু হওয়ায় হত্যা, গোলাগুলি, অপহরণের ঘটনা ঘটছে। দুর্গম কোনও পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের সময় সেনাবাহিনীর মতোই পোশাক পরিহিত অবস্থায় ভিডিও করে তারা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারে নেমেছে। কেএনএফের প্রধানের পুরো নাম নাথান লনচেও বম। ৪১ বছর বয়সী নাথান বম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বান্দরবান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। নাথান বম রুমা উপজেলার হেড়েরপাড়ার বাসিন্দা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভাষ্কর্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ¯œাতকোত্তর নাথান এক সন্তানের জনক। তার স্ত্রী স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক। ২০০৮ সালে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা রূপ বদলাতে থাকে। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন রূপ ধারণ করেন নাথান। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা করেন কেএনএফ।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলাকালে এমন ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কেএনএফ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের আস্তানা আগেই নিশ্চিহ্ন করে দেবার পরও তারা কীভাবে এই হামলা পরিচালনা করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।