বাংলাদেশ-চীন সামরিক মহড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অস্বস্তি
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:০৩ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ শনিবার
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়াকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত অস্বস্তিতে পড়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এই মহড়ায় অংশ নিতে চীনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’র একটি দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। জাতিসংঘের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের আলোকে এটি একটি প্রশিক্ষণ মহড়া। এই মহড়ায় জিম্মি উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস করা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও চীনের সামরিক বাহিনীর মধ্যে এটা এই ধরনের প্রথম কোনও মহড়া। চীনের এই মহড়ার খবরে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রান্ধির জেনসওয়াল বলেছেন, প্রতিবেশি রাষ্ট্র এবং তার বাইরে যা কিছু ভারতের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তাজনিত স্বার্থের ওপর প্রভাব ফেলে সেগুলোর দিকে দিল্লি নিবিড় নজর রাখবে। তিনি সাংবাদিকদের এও বলেন যে, এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে’। তিনি অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় বাংলাদেশকে মার্কিন বলয়ে যুক্ত হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছে। মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা ও আইপিএস বিশেষজ্ঞ ম্যাক্সওয়েল মার্টিন এও বলেছেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ নিরসনে তারা বোরো ফসল নিরাপদে তোলার প্রতি জোর দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে তৃতীয় কোনও দেশের দৃষ্টিতে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন মনে করে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি হলো অভিন্ন ইতিহাস, অভিন্ন মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
বিশে^র শক্তিশালী দেশগুলোর এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা একটি সাম্প্রতিক প্রবণতা। চীনের উত্থানের সঙ্গে এই প্রতিযোগিতা ডালপালা মেলেছে। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সংক্ষেপে বিআরআই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র তা মোকাবেলায় তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) গঠন করেছে। তাছাড়া, সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তার দিকে জোর দিয়ে গঠন করা হয় কোয়াড। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া এই জোটের সদস্য হিসাবে নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। আইপিএসের আওতায় ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরাম (আইপিইএফ) গঠনও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ বিআরআইয়ে আগে যোগদান করেছে। তবে আইপিএসে যোগদানের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক বেশি করেছে। বঙ্গপোসাগরের নিয়ন্ত্রন নিয়ে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারে এখনও চীন অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে। মালদ্বীপে নতুন সরকার একটি চীনপন্থী সরকার। নেপালেও চীনের নিয়ন্ত্রণ আছে। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ যেন সম্পূর্ণরুপে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ^স্ত মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তবে বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সামরিক ক্রয়ের সিংহভাগ চীন থেকে আসে। বাংলাদেশের জলসীমা পাহারা দেবার লক্ষ্যে দু’টি সাবমেরিন ক্রয় করেছে। পেকুয়ায় সাবমেরিনের টারমিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ব্যাপকভাবে চীনের অনুকূলে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএসে বাংলাদেশ সরাসরি যোগদান না করলেও ঢাকার তরফে বাংলাদেশের নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ মূলত এই অঞ্চলে কোনও প্রকার সামরিক উত্তেজনা চায় না। এ কারণে কোনও সামরিক বলয়ে যোগ দিতে চায় না। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারের লক্ষ্যে যে কোনও জোটের সঙ্গে কাজ করতে কোনও আপত্তি নেই। আইপিএসের পাচটি স্তম্ভ রয়েছে। বাংলাদেশ এদের এক বা একাধিক পিলারের সঙ্গে কাজ করতে পারে। এই বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরীতা নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হল, বাংলাদেশ কোনও বলয়ভুক্ত হয় না। অর্থাৎ বাংলাদেশের নীতি হলো, ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখা। কাজটা কঠিন হলেও আপাতত এই নীতির কোনও বিকল্প নেই।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা একটি উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল চায়। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গেও কাজ করতে আগ্রহী। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে। এটার মাধ্যমে সমৃদ্ধি, যোগাযোগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা জোরদার এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেন, আইপিএস একটি ইতিবাচক কৌশল। এই লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত, শিক্ষাবিদদেও দায়িত্ব রয়েছে।
মার্টিন ম্যাক্স বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চীন সংক্রান্ত পলিসি রয়েছে। কারণ এই অঞ্চলে চীন হলো বড় একটি খেলোয়ার। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুশাসন। আমরা এই অঞ্চলে কোনও দেশ অধিপত্য বিস্তার করুক এবং কোনও দেশ আধিপত্যের শিকার হোক এটা চাই না। এই অঞ্চল বিশে^র সবচেয়ে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এ জন্যে বৈশি^ক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক তৈরী করাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বগত জানায়। একুশ শতকে আন্তরাষ্ট্রীয় হুমকির মধ্যেও অর্ন্তভুক্তিমুলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং পরিবেশগত উন্নতি।
যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাংলাদেশের উন্নতির সোপান বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে উসাহিত করা হলেও বাইডেন প্রশাসন সর্বশেষ বিশে^র মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ড খারাপ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন বলেছেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে উন্নতির কথা উল্লেখ নেই বলে সেহেলি সাবরিন জানান। এদিকে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা চলমান রয়েছে।