শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৬ ১৪৩১   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতির গেম চেঞ্জার মাতারবাড়ী

নিউজ ডেস্ক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫১ পিএম, ৭ মে ২০২৪ মঙ্গলবার

বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ইউনিয়ন। কয়েক বছর আগেও এই অঞ্চলের মানুষজন অভ্যস্ত ছিল দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনযাপনে। অবস্থানগত কারণে মাতারবাড়ী ঘিরে সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটির কাজ শেষে অপারেশন শুরু হয়েছে। কিছু শেষের পথে এবং কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীন-জাপানের কাছে কৌশলগত দিক থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ স্থান মহেশখালীর মাতারবাড়ী। মহেশখালী ঘিরে যে কর্মযজ্ঞ তার সুবিধা পাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত দক্ষিণ-পূর্বের সাত রাজ্যও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তাদের মতে, মাতারবাড়ী ক্রমেই হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গেম চেঞ্জার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে তৈরি হতে যাচ্ছে বাণিজ্যিক হাব। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ১২ শ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ আর মহেশখালীর সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত গ্যাস। এর সঙ্গে গভীর সমুদ্রে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে এখন এটি কমিশনিং পর্যায়ে আছে। এতে গোটা অঞ্চলটি এক বিশাল পাওয়ার হাবে রূপ নিয়েছে। আবার দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি টার্মিনালের নির্মাণ ২০২৬-এ শেষ হলে ট্রানজিট ভোগান্তি ছাড়াই ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরাসরি পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবেন দেশের ব্যবসায়ীরা।

মাতারবাড়িতে আছে যেসব প্রকল্প : বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যে মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকায় আছে মাতারবাড়ি ১২ শ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মহেশখালীতে এরই মধ্যে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। এর একটি আমেরিকান কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। আরেকটি দেশি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের। এখানে ভবিষ্যতে আরও দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে সাগরে স্থাপন করা হয়েছে এসপিএম প্রকল্প। সেখানে জাহাজ থেকে তেল সরাসরি পাম্প করা হবে, যা এসপিএম হয়ে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ির যেখানে ল্যান্ড টার্মিনাল শেষ হয়েছে সেখানে পৌঁছাবে। পরে সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় নির্মিতব্য স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি টার্মিনালের। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাবে জুনে : মাতারবাড়ি ১২ শ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে আগামী জুনে। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। জাপানের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত দুই ইউনিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় গত বছর ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে। আর ২৪ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। প্রকল্পটির এ পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ আর আর্থিক অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। শতভাগ সরকারি মালিকানায় উৎপাদনে থাকা দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এটি। এটি বাস্তবায়ন করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বাকি টাকা সিপিজিসিবিএল তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১১ নভেম্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। 

সিপিজিসিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন লোডে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এই পরীক্ষা শেষ হলেই তা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আমরা সর্বোচ্চ ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি। আশা করছি, জুনে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারবে। দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পায়রা ও রামপাল থেকে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম। অন্য কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকার বেশি খরচ হলেও মাতারবাড়িতে খরচ হচ্ছে আট টাকা। বর্তমানে কেন্দ্রটির জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে ঋণচুক্তি হয়। 

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়িতে ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার চার ইউনিটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই বিবেচনায় বাড়তি জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি সীমানা প্রাচীর, ভবন ও কয়লা আমদানির জেটি নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ শেষ। দ্বিতীয় প্রকল্পে এখন শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি বসানো হলেই বাড়তি আরও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এতে এক জায়গাতেই ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মহেশখালীতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে ভবিষ্যতে এই এলাকা ‘হংকং’-এর মতো হয়ে উঠবে। এখানে একদিকে যেমন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে অন্যদিকে এই বিশাল উন্নয়নকাজের জন্য স্থানীয় বাসিন্দার প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর যে স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি প্রকল্পের কাজে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তাদের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চলতি বছরই শুরু গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের নির্মাণকাজ : দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরে মাতারবাড়ির টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে চলতি বছরের মাঝমাঝি সময়ে। যা আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গভীর এ সমুদ্রবন্দর চালু হলে অর্থের পাশাপাশি সাশ্রয় হবে সময়েরও। একই সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যিক ও এনার্জি হাব তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার; যা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে পুরো দেশের অর্থনৈতিক চিত্র।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের নির্মাণকাজ জুন-জুলাইয়ে শুরু করার টার্গেট নির্ধারণ করেছি। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুতই নির্মাণকাজে হাত দেব। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যা দেশের জিডিপি ও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন দেশ এ বন্দর ব্যবহারের কারণে বৃদ্ধি পাবে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও।’ 

জানা যায়, মাতারবাড়ী টার্মিনালের নির্মাণকাজের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্যাকেজ-২-এর আওতায় কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রাংশ, সিকিউরিটি সিস্টেম ক্রয় প্রস্তাব নৌপরিবহন মন্ত্রাণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্যাকেজ-২বি-এর আওতায় টার্গ বোট, সার্ভে বোট, পাইলট বোট এবং ভিটিএমএস কারিগরি মূল্যায়ন করে জাইকার কাছে অনাপত্তির জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাশাপাশি চ্যানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরে থাকবে একটি ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি, একটি ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং জেটি। এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩ কিমি দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ, ১৮ দশমিক ৫ মিটার (এমএসএল) গভীরতার বন্দর চ্যানেল। চ্যানেল ও হারবার নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ১ হাজার ৭৫৩ মিটার উত্তর ব্রেকওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ), ৭১৩ মিটার দক্ষিণ ব্রেকওয়াটার এবং উত্তর দিকে ১৮০২ দশমিক ৮৫ মিটার রিভেটমেন্ট। গভীর সমুদ্রবন্দরকে জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বাণিজ্যিক হাব তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অত্র অঞ্চলে উন্নত যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আনা হচ্ছে। মাতারবাড়িকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। মাতারবাড়ির সঙ্গে দেশ-বিদেশের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করতে কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে রূপ দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রসারণ প্রকল্পটি চলতি বছরেই শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যটন নগরী ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় ইউরোপ এবং আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির জন্য সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দরকে ব্যবহার করতে হচ্ছে। তৃতীয় দেশ হয়ে পণ্য রপ্তানির কারণে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় হচ্ছে। সময়ও লাগছে বাড়তি ১০ থেকে ১৫ দিন। দেশের আমদানি-রপ্তানি কমাতে এবং গতিশীল করতে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা।