ডোনাল্ড লু’র সফরে নতুন যাত্রার সূচনা উষ্ণ সম্পর্কে ওয়াশিংটন-ঢাকা
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:০৭ এএম, ১৮ মে ২০২৪ শনিবার
ডোনাল্ড লু’র এবারের বাংলাদেশ সফর ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের নতুন যাত্রার সূচনা করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের টানাপোড়েনের অবসান ঘটাতে নতুন বার্তা দিয়েছেন লু। তিনি বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে টেনশন ছিল। সেখান থেকে আস্থা ফেরাতে তার সফর। মার্কিন এই পদস্থ কর্মকর্তা আরও খোলাসা করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাকাতে চায়, পেছনে ফিরে যেতে নয়। এমন প্রাঞ্জল কথামালার পাশাপাশি কার্যকর কিছু পদক্ষেপও রয়েছে। এই সফরে তিনি বিএনপি’র অনুরোধ উপেক্ষা করে দলটির কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে সরকারি মহলের এন্তার অভিযোগ। বিষয়টি অজানা নয় ওয়াশিংটনের। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাংলাদেশে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে ডেভিড মিলের নাম ঘোষণার পর সফরে আসেন ডোনাল্ড লু। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বরফ কতটা গলবে এখন সেটাই দেখার বিষয়। মন্ত্রীদের সঙ্গে লু’র ভাল বৈঠক হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষাৎ দেননি। এতে স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেনশন সতর্কভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করার পর শেখ হাসিনা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন।
বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের আগে ঢাকার ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসনের তরফে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচন করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসেছেন। এক পর্যায়ে ওয়াশিংটন বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভিসানীতি নামের এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করবে; তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। এমনকি তাদের পরিবারবর্গকেও ভিসা দেবে না কিংবা ভিসা থাকলে তা বাতিল করবে বলে ঘোষণা করে। এমন কথাও চাউর হয়েছিল যে, নির্বাচনের আগে কিংবা পরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। বাস্তবে নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন চিঠি দিয়েছেন শেখ হাসিনার কাছে। চিঠিতে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় অভিনন্দন না জানালেও বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশি^ক ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করবে জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে দুই দেশ একত্রে কাজ কতটা করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শেখ হাসিনার সরকার সবচেয়ে বড় অস্বস্তিতে ছিল ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে। নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়া, বিএনপি অফিসে ভুয়া বাইডেনের উপদেষ্টার উপস্থিতিসহ নানা কারণে তার ভূমিকা পক্ষপাত দুষ্ট বলে মনে করেছে আওয়ামী লীগ। এখন তার পরিবর্তে ঢাকা নতুন রাষ্ট্রদূত হিসাবে ডেভিড মিলের নাম ঘোষণা করেছে। ডেভিড মিল বাংলাদেশে এর আগেও মার্কিন কূটনীতিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এবার সরাসরি রাষ্ট্রদূত হয়ে আসছেন।
ডোনাল্ড লু মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ডেস্কের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া তার দেখভালের আওতাধীন অঞ্চল। এবারে ঢাকায় আসার আগে ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন লু। কলম্বো থেকে ১৪ মে সরাসরি ঢাকায় আসেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন তাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেন। সফরকালে তিনি সুশীল সমাজের কারও কারও সঙ্গে চা চক্রে মিলিত হয়েছিলেন। সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শ্রম ও মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি নানা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। অনেকে মনে করেন, এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এখনও রয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী লড়াই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনরোধেও বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
বাইডেন প্রশাসনের অনেকটা ইউটার্ন নেয়ার কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বেশ কিছু কারণ আবিস্কার করেছেন। তাদের মতে, বাইডেন প্রশাসন বাস্তবতা মেনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বাস্তবতা মেনে নেয়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নয়। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সেখানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। তখন ওই দাঙ্গার জন্য মোদিকে দায়ী করেছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন মোদিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। তাকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ভারতে কেন্দ্রীয়ভাবে তখন কংগ্রেস দল ক্ষমতায়। তবুও জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখতে দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল ভারত। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দেয়। সেই সংবর্ধনায় তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এই ধরনের বহু ঘটনা আছে যাতে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতা মেনে নেয়।
বৈশি^ক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার জন্যে বাইডেন প্রশাসানকে আগ্রহী করেছে। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অধিপত্য অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বেড়েই চলেছে। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো দেশে চীনপন্থী সরকার গঠিত হয়েছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি চীনপন্থী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। কারণে বাংলাদেশে গোলযোগ হলে সেই সুযোগ চীন নিতে পারে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ বানাতে চায় বাইডেন প্রশাসন। বাইডেনের সামনে নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেখানে তরুণ প্রজন্ম গাজায় নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। একদিকে রাশিয়াকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে নিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, গাজায় ইসরাইলি হামলাতেও সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন বাস্তবতায় বলাদেশকে পরিপূর্ণ সহযোগী হিসাবে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিক্ত সম্পর্ক পিছনে ফেলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।