সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাইসিকে কেন ‘তেহরানের কসাই’ বলে আমেরিকা?

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৫৭ এএম, ২২ মে ২০২৪ বুধবার

রহস্যজনক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর রীতিমতো শোকাহত ইরান। অথচ পর্দার আড়ালে উল্লাসে মাতোয়ারা ইরানিদের অপর একটি অংশ। রাইসির ‘ভয়ংকর’ রূপ দেখার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। ভুক্তভোগীদের কাছে তিনি ‘তেহরানের কসাই’।

ইরানিরা তাদের মহান নেতাকে হারিয়ে তাবরিজ, মাশহাদ, তেহরানসহ বিভিন্ন শহরে কালো পোশাকে মাতম করছেন। রাষ্ট্রের কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরানের সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে বহির্বিশ্বে এটি ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে।

ইরানের সংবাদমাধ্যমের বর্ণনায় বলা হচ্ছে, রাইসি ইরানিদের কাছে সর্বজন নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ‍উঠছিলেন। তিনি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উত্তরসূরি হতে চলেছিলেন। কিন্তু কেন কঠোর খামেনি রাইসিকে তার যোগ্য প্রতিনিধি মনে করছিলেন?

কারণ, রাইসি ছিলেন সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে অন্যতম কট্টরপন্থি। তার নিষ্ঠুরতার বলি যারা হয়েছেন তারাই জানেন, রাইসি কেমন শাসক ছিলেন। খামেনির ইচ্ছেমতো চলায় রাইসি ইরানের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রিয় ছিলেন।

রাইসির মৃত্যুতে ইরানে উল্লাস করছে কারা?

পশ্চিমা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রাইসির পেছনের রূপটিও তুলে ধরেছে। দ্য ইকোনমিক টাইমস, ইউরো নিউজ, দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট, ফক্স নিউজ রাইসির অতীত জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে রাইসিকে ‘তেহরানের কসাই’, ‘সংরক্ষণশীল নেতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইরানের বিভিন্ন স্থানে রাইসির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উৎসবের কারণ জানাতে গিয়ে সাংবাদিক ও বিশ্লেষক জোনাথন হ্যারনওফ ইরান ইন্টারন্যাশনালকে বলেন, ‘একজন সংরক্ষণশীল নেতা ছিলেন রাইসি। এর পাশাপাশি কঠিন বিচারব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমেই তিনি নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছেন। (শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে) হাজারো বন্দির প্রাণ গেছে তার হাতে। আর এ কারণেই তাকে তেহরানের কসাই ডাকা হয়।’

কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনি নিহতের ঘটনা মনে করিয়ে দেন বেশ কয়েকজন নারীবাদী। এ ছাড়া পরবর্তী আন্দোলন ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে কঠোর হাতে দমন করেন রাইসি। সে সময় মূলত বিরোধীমতের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করে নিজের শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অভিপ্রায় ছিল বলে অভিযোগ।

রাইসির জন্ম ইরানের দ্বিতীয় বড় শহর মাশাদে ১৯৬০ সালে। ইরানের পবিত্রতম শিয়া দরগাটি রয়েছে এ শহরে। রাইসির বাবা ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা। রাইসির বয়স যখন পাঁচ তখন তার বাবা মারা যান। শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি ইসলামের নবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরেন। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি ১৫ বছর বয়সে পবিত্র কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন।

সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লা রুহুল্লা খামেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ-এর শাসনের পতন ঘটে। বিপ্লবের পর তিনি যোগ দেন বিচার বিভাগে এবং আয়াতুল্লা খামেনির কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে বেশ কয়েকটি শহরে কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করেন।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাইসি তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন। মূলত এ নিয়োগ ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। ছিল এক কালো উদ্দেশ্য। যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেন রাইসি।

অভিযোগ আছে, যে চারজন বিচারককে নিয়ে ১৯৮৮ সালে ‘ঘাতক কমিটি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা গোপন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন সেই চারজনের একজন। যে হাজার হাজার বন্দি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এরই মধ্যে জেল খাটছিলেন, ওই ট্রাইব্যুনাল তাদের ‘পুনর্বিচার’ করে।

এদের বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থি বিরোধী দল মুজাহেদিন-ই-খাল্কের (এমইকে) সদস্য। এই গোষ্ঠী পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন অব ইরান বা পিএমওআই হিসেবেও পরিচিত ছিল। ঠিক কতজনকে ওই ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল সেই সঠিক সংখ্যা জানা যায় না।

কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে, প্রায় ৫০০০ পুরুষ ও নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল এবং অজ্ঞাত গণকবরে তাদের মাটি দেওয়া হয়, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে তারা তুলে ধরে।

মৃত্যুদণ্ডে তার ভূমিকার কথা রাইসি বারবার অস্বীকার করেন। তবে তিনি এ কথাও বলেন, ইরানের সাবেক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লা খামেনির জারি করা ফতোয়ার কারণে ওই মৃত্যুদণ্ডাদেশ যুক্তিসংগত ছিল।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল বলছে, ইব্রাহিম রাইসি ইরানের একজন ধর্মীয় ‘কট্টরপন্থি’ নেতা ছিলেন। ইরানে বাকস্বাধীনতাকে ধ্বংস করা এবং নারীদের জন্য কঠোর ‘হিজাব আইন’ প্রয়োগ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। পশ্চিমাদের মতে, নারীদের কোনঠাসা করতে সারা জীবন কাজ করে গেছেন তিনি।

রাইসির পেছনের এসব ইতিহাস ভুক্তভোগীদের মনে পড়ছে। তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। খোদ ইরানে রীতিমতো আতশবাজি ফাটিয়ে উৎসবে মেতেছে ইরানিদের একাংশ। যদিও এ ধরনের উৎসব বন্ধ করতে এরই মধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা।