যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয়বহুল সফরে ২৬ ব্যাংক এমডি
হাসান মাহমুদ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১০:০৮ পিএম, ২৪ মে ২০২৪ শুক্রবার
বাংলাদেশে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা
ও নৈশভোজের খরচ ৬৫ লাখ টাকা
দেশে-প্রবাসে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করে বাংলাদেশের ২৬টি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) দল বেঁধে এখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। তারা এমন এক সময়ে এসেছেন যখন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ডলার এবং নগদ অর্থের অভাবে এক ভয়াবহ দুর্গতিতে রয়েছে। মানুষ ব্যাংকে টাকা পাচ্ছে না। সফররত এই এমডি’রা দেশে ডলার প্রবাহ বাড়াতে ‘অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট’ নামে রেমিট্যান্সের একটি নতুন প্রস্তাব প্রবাসীদের কাছে তুলে ধরতে চান। ডলার পাঠাবার এই নতুন উদ্ভাবিত প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত সতর্কভাবে এবং যত্ন সহকারে বিশেষভাবে তৈরি। পাঁচটি ব্যাংকের এমডি মিলিতভাবে এ আয়োজন করছেন।
এ প্রস্তাব নিয়ে তারা আজ শুক্রবার আলোচনায় মিলিত হচ্ছেন। এজন্য সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট ম্যারিয়ট হোটেলে ব্যয়বহুল নৈশ ভোজের আয়োজন করেছেন। এই ডিনারে প্রধান অতিথি থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান। বিশেষ অতিথি থাকবেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমান ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা। সফররত পাঁচটি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি আর এফ হোসেইন, ডাচ বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো: শিরিন, ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হোসেইন, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোরশেদুল কবীর ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাশরুর আরেফিন এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন।
জানা গেছে, সাড়ে তিন ঘন্টার এই অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ডলার। পাঁচটি ব্যাংক এই অর্থ পরিশোধ করছে। এই ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে নির্ধারিত কিছু ব্যাক্তিকে। বলা হয়েছে, আলোচনা পর্ব শেষে থাকবে নাচ-গানের ব্যবস্থা।
২৬টি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এই সফর সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে তিনি টেলিফোনে ‘আজকাল’কে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এখন চরম অর্থ সংকটে রয়েছে। শুনেছি দল বেঁধে এমডি’রা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। বিদেশে এসব অনুষ্ঠান করে ডলার প্রবাহ বাড়ানো যায় না। অর্থের অপচয় ছাড়া এসব আর কিছু নয়।’
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ঢাকা থেকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের কোন আস্থা নেই। ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত নিরাপদ রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে’।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ব্যাংকের এমডিদের আজকের ডিনারের খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার, প্রতি ডলার ১১৯ টাকা হলে তাতে ব্যয় হচ্ছে ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। নিউইয়র্কে সাড়ে তিন ঘন্টার এই বৈঠকে এত বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ করার পর বাংলাদেশে ‘অফশোর ব্যংকিং ফিক্সড ডিপোজিট’-এ রেমিট্যান্সের জোয়ার সৃষ্টি হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞ মহলে। কারণ নিউইয়র্কের হাজার হাজার রেমিট্যান্স দাতারা এই ব্যয়বহুল ব্যাংকিং অনুষ্ঠানের সামান্যতম খবরও জানেন না।
আজকের ডিনারে বক্তা তালিকায় রয়েছেন কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার ‘আজকাল’কে বলেন, ‘সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহ জোরদার করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে বৈধভাবে বেশি বেশি ডলার দেশে পাঠানো যায়। দেশের স্বার্থে ডলার পাঠানো জরুরি’।
‘আজকাল’-এর হাতে আসা কিছু ডকুমেন্টে দেখা যায়, আজকের ডিনারের এজেন্সি সার্ভিসের জন্য ৬ হাজার ডলার খরচ হচ্ছে। দুইজন সঙ্গীত শিল্পীর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ ডলার। ২ জন নৃত্যশিল্পীর জন্য জন্য ৬০০ ডলার। ডিনার এবং হল ভাড়া বাবদ খরচ হবে ৩১ হাজার ৫০০ ডলার। প্রতিটি খরচই ডলারে পেমেন্ট করতে হবে। এজন্য ঢাকার গুলশানে সিটি ব্যাংক পিএলসির একাউন্টে ডলার জমা করা হয়। নিউইয়র্কে বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ও আমলাদের জন্য আয়োজিত আজকের অনুষ্ঠানের জন্য প্রত্যেক ব্যাংককে ১১ হাজার ডলার করে দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমদানি ব্যয় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মার্কিন ডলার কিনে চলতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। ব্যাংকগুলোতে চরম ডলার সংকট চলছে। ডলার কিনতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ (টাকা) আটকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফলে ব্যাংকে তৈরি হয়েছে চরম তারল্য সংকট। এর ফলে মানুষ টাকা পাচ্ছে না। টাকা শূন্য হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক। ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার কিনেছে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তারা জমা দিয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে ব্যাংকগুলো টাকা শূন্য হয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ২৬ ব্যাংকের এই এমডিরা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। এ বিষয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই সফরে তাদের জন্য ব্যয় হবে সোয়া দুই লাখ ডলার। যা বাংলাদেশি অর্থে তিন কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সরকারি ও প্রাইভেট ব্যাংকগুলো দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্বল থেকে দুর্বল হচ্ছে এমন অভিযোগ দেশের মানুষের মুখে মুখে। ব্যাংকগুলির এই দুর্গতিতে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় অর্থাৎ রেড জোনে যে ব্যাংকগুলি রয়েছে সেগুলি হচ্ছে- জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। এছাড়া সোনালী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রেড জোনের খুব কাছে অবস্থান করছে বলে ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স সূত্রে জানা যায়।
ইয়েলো জোনে অবস্থান করছে ৩টি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক, ১৯টি প্রাইভেট ব্যাংক এবং ৮টি শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে- সোনালী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক, এআরবিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সিটি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অন্যতম। বাংলাদেশে মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রীন জোনে রয়েছে।
নিউইয়র্কে রেমিট্যান্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান মানি ট্রান্সমিটার এন্ড এজেন্ট’ এবিএএমটিএ’র সভাপতি মাসুদ রানা তপন বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়ে বাস্তবে আমরা কাজ করছি। অথচ অপেশাদার ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় ব্যাংক মালিকদের এনে অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।