রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মোদির জয় মোদির হার

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৯:৫৬ এএম, ৮ জুন ২০২৪ শনিবার

দিল্লিতে শপথ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন হাসিনা

বিজেপির রামমন্দির ইস্যু প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত
 

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি বেশি আসনে জয়ী হলেও কাঙ্খিত জয় পায়নি। এবারের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও হারিয়েছে তারা। যদিও বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটÑএনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স) সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। ফলে টানা তৃতীয় বারের মতো শপথ নিতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।
বিজেপি নেতৃত্বধীন এনডিএ জয়ী হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে মোদির এক রকম পরাজয় হিসেবেই দেখছেন। কেননা, বিজেপিকে সমমনা দশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়েই ক্ষমতায় যেতে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যেও সেই ঈঙ্গিতই মিলেছে। মোদি বলেছেন, ‘হার-জিত রাজনীতির অঙ্গ। কখনো জয় হবে, কখনো হার। এই খেলাই নিরন্তর। এতে ভেঙে পড়লে চলবে না।’ গত বুধবার সকালে বিদায়ী মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেওয়া ভাষণে এ মন্তব্য করেন ভারতের নরেন্দ্র মোদি। বলেন, ‘টানা ১০টা বছর আমরা চমৎকার কাজ করেছি। আগামী দিনেও সেই ধারা অব্যাহত রাখব।’
মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকেই মোদিকে আবার সরকার গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। রাত পৌনে আটটায় শরিকদের সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রিসভা গড়ার দাবি জানিয়ে আসেন। নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, নতুন সরকার শপথ নেবে ৮ জুন শনিবার। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের গত রাতে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর বিকেল চারটায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে শুরু হয় এনডিএর বৈঠক। তাতে যোগ দিতে দিল্লি চলে আসেন বিহার থেকে নীতীশ কুমার, চিরাগ পাসোয়ান, হায়দরাবাদ থেকে চন্দ্রবাবু নাইডু, লক্ষ্মৌ থেকে জয়ন্ত চৌধুরী, মুম্বাই থেকে একনাথ শিন্ডের মতো ২১ জন নেতা। তারা সবাই সরকারকে সমর্থনের চিঠি নিয়ে হাজির। সেখানেই সবাই সর্বসম্মতিক্রমে নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে মেনে নেন। সেই বৈঠকেই মোদি জানান, গুরুত্বপূর্ণ শরিক নেতাদের সঙ্গে নিয়েই তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে সরকার গড়ার দাবি পেশ করবেন।
এই প্রথম নরেন্দ্র মোদিকে কোয়ালিশন সরকার চালাতে হবে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর কখনো হয়নি। মন্ত্রিসভায় কে কোন দপ্তর পাবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কোয়ালিশন বা জোট সরকারে সাধারণত দেখা গেছে, প্রধান শরিক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজের কাছে রাখে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারেও মনমোহন সিং এই তিন মন্ত্রণালয় ধরে রেখেছিলেন। এবারও এই তিন দপ্তর বিজেপি কাছছাড়া করবে না। এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর হলো প্রতিরক্ষা, কৃষি, রেল, গ্রামোন্নয়ন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয়। তথ্য ও সম্প্রচার এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দুই প্রধান শরিক নীতীশ কুমারের জেডিইউ ও চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপিসহ অন্য শরিকেরা কোন দপ্তর পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেন, দু-এক দিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হবে।
মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। যেমন নীতীশ কুমারের দলের এক নেতার কথা অনুযায়ী তাঁরা রেল, গ্রামোন্নয়ন ও জলসম্পদের মতো মন্ত্রণালয় চান, যাতে রাজ্যের উন্নতি করা যায়। নীতীশ কুমার নিজেও একসময় রেলমন্ত্রী ছিলেন। তাঁরই রাজ্যের নেতা লালু প্রসাদ ও প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানও রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিহারের সঙ্গে রেল মন্ত্রণালয়ের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, অন্তত তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও নীতীশ কুমার চান বিহারকে কেন্দ্র বহু প্রতিশ্রুত বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা এবার দিক। নীতীশ কুমার ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে রাজ্য বিধানসভার ভোট দ্রুত করিয়ে ফেলতে আগ্রহী।
এবার ভোটে নীতীশের দল বিহারের ৯৪ লাখ গরিব পরিবারকে দুই লাখ রুপি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই অর্থের জোগানে যাতে টান না পড়ে, সেই দাবিও তিনি মোদির কাছে রাখবেন বলে দলীয় সূত্রের খবর।
চন্দ্রবাবু নাইডুর দাবিও অন্তত তিনটি ‘ভালো’ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে লোকসভার স্পিকারের পদ। তেলেগু দেশমের সদস্য জি এম বালাযোগী ১৯৯৮ সালের জোট সরকারের সময় লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন। ২০০২ সালের মার্চ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। সেই মাসেই রাজ্যে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। একই রকম চিরাগ পাসোয়ান, জয়ন্ত চৌধুরী, একনাথ শিন্ডেদেরও খুশি রাখতে হবে মোদিকে।
এদিকে, মোদির সাম্প্রদায়িকতার কৌশল এবার ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর প্রদেশে অবস্থিত রামের জন্মস্থান অযোধ্যায় পর্যন্ত বিজেপি হেরেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানুয়ারিতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদকে সরিয়ে রাম মন্দির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন।
‘ইন্ডিয়া’ জোটের বৈঠক:
গত বুধবার বিকেলে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের বাসভবনে বসে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বৈঠক। বিরোধী নেতাদের প্রত্যেককে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকে এক জোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। জনতার রায় পুরোপুরি মোদির বিরুদ্ধে। এটা তাঁর রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয়। খাড়গে বলেন, জনতার রায় বুঝিয়ে দিয়েছে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় দেশ জোটবদ্ধ।
শনিবার দিল্লি যাচ্ছেন শেখ হাসিনা: নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। শপথ অনুষ্ঠান হবে রোববার। এতে যোগ দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি মোদির বিজেপি। এনডিএ জোটের শরিকদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা হচ্ছে। এই সময়ে শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে।
মোদির জোট লোকসভার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর পরই শেখ হাসিনা অনেকটা ঝড়ের গতিতে অভিনন্দন জানান। শেখ হাসিনা ও মোদির মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ব নির্ধারিত ভারত সফরের কর্মসূচি থাকায় বিষয়টা বেশ জটিল ছিল। শেখ হাসিনা আগামী ২২ জুন ২০২৪ দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারত যাবেন বলে কর্মসূচি ঠিক করা হচ্ছিল। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানে যাবার জন্যে মোদির অনুরোধ ফেলতে পারেননি। ফলে এত কাছাকাছি সময়ে দ্বিপক্ষীয় সফর করা সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন।
মোদির শপথ অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল শনিবার সন্ধ্যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বৃহস্পতিবার সকালে আজকালকে বলেন, ‘হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাবেন শুক্রবার। শনিবার সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। রোববার ফিরবেন’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও সফরসঙ্গী হবেন বলে জানান। কিন্তু বিকেলে দিল্লি থেকে খবর আসে, শপথ অনুষ্ঠান একদিন পিছিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের কী হবে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরও একদিন পিছাবে। শনিবার দিল্লি যাবেন। রোববার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সোমবার ফিরে আসবেন’।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্বনির্ধারিত ২২ জুনের দ্বিপক্ষীয় ভারত সফর হচ্ছে না। এরিমধ্যে তার সফরসঙ্গীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী ২২ জুন দিল্লি যাচ্ছেন না বিধায় সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ফলে এই যাত্রায় এই সফরই হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী জুলাইয়ে চীন সফরে যাচ্ছেন। তারপর ব্রাজিল। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন।
জওহরলাল নেহেরুর পর টানা তিন মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর কেউ হয়নি। তবে বিগত দুইটি সরকারের আমলে মোদির দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। ভারতের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টে নি¤œকক্ষের নাম লোকসভা। ৫৪৩ আসন বিশিষ্ট লোকসভার ক্ষমতা দখল করতে ২৭২ আসন প্রয়োজন। এনডিএ জোটের বড় দল বিজেপি এই আসন পায়নি। তাই জোটের দিকে ছিল সবাই তাকিয়ে। বিজেপি’র জোট এনডিএ ভেঙ্গে গেলে বিরোধী দলীয় ইনডিয়া জোটের ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা থাকে।
এনডিএ জোটের অন্ধ্র প্রদেশের আঞ্চলিক দল তেলেগু দেশম পার্টি এবং বিহারের আঞ্চলিক দল জনতা দল ইউনাইটেড জোট ভেঙ্গে বিরোধী জোটে গেলে মোদির ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে ভোট ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ টেলিফোনে কথা বলেন তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডো এবং জনতা দল ইউনাইটেড নেতা নিতিশ কুমারের সঙ্গে।
মোদির সাম্প্রদায়িকতার কৌশল এবার ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর প্রদেশে অবস্থিত রামের জন্মস্থান অযোধ্যায় পর্যন্ত বিজেপি হেরেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানুয়ারিতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদকে সরিয়ে রাম মন্দির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছেন। ফলে তুলনামূলক একটা দুর্বল মোদির সরকারের প্রতি সমর্থন জানাতে শেখ হাসিনা উড়ে যাচ্ছেন দিল্লি।