শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

২১ জুন ভারত, ৮ জুলাই চীন সফর

হাসিনার হাতেই মোদি-শি

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৪২ এএম, ১৫ জুন ২০২৪ শনিবার



 
শেখ হাসিনার ‘ফ্লায়িং ডিপ্লোম্যাসি’ অনেকের নজর কাড়ছে। সেদিন দিল্লি থেকে এসে আবার সেখানে উড়ে যাচ্ছেন। ২১ জুন দু’দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারত যাচ্ছেন তিনি। মোদির আমন্ত্রণের সফরটি শেষ হওয়ার পর পরই যাবেন বেইজিং। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন আগেই। দিল্লি, বেইজিং উভয়ে চেয়েছিলো চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা যেন তাদের দেশে প্রথম সফর করেন। মোদি ও শি উভয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই ভারসাম্য বজায় রেখে তার এবারের সফরকে সাজানো হয়েছে।
একতরফা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর পরই কে আগে অভিনন্দন জানাবেন মোদি নাকি শি এটা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছে। শেখ হাসিনার ভারত যাবার দিনক্ষণ পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি শপথ অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতাকে আমন্ত্রণ জানান। তার মধ্যে শেখ হাসিনাও ছিলেন। গত ৮ জুন তিনি দিল্লি গিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও তার মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মোদির সঙ্গে তখন বৈঠকও হয়েছিলো। আবার বিরোধী কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে আলিঙ্গন দৃশ্য সবার নজর কেড়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নির্বাসিত জীবন গান্ধী পরিবারের সঙ্গে কেটেছে। সেই আবেগ মোদির আমলেও মুছে ফেলতে পারেননি। বিজেপি’র ভেতরে এখন কোনঠাসা বর্ষিয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গেও দেখা করেছেন হাসিনা। এই রকম একটা শোডাউনের পর অনেকে ভেবেছিলেন, দ্বিপক্ষীয় সফরটা এখনই হচ্ছে না। আগামী ৭ জুলাই শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিং যাবার কথা রয়েছে। ফলে দ্বিপক্ষীয় সফর চীনে প্রথমে হচ্ছে এমন মনে হতে পারে। তাই সাউথ ব্লকের জোর কূটনৈতিক তৎপরতায় আবারও দিল্লি যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। চীন ও ভারতের মধ্যে ভারতেই তাকে আগে যেতে হচ্ছে।
ভারতে আগে সফরে গেলে দিল্লির লাভ কোথায়। বাংলাদেশে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে কোনও দল প্রথম সরকার গঠনের পর প্রথম সফর চীনে করেছেন। খালেদা জিয়াও বেইজিং গেছেন। শেখ হাসিনাও বেইজিং গিয়েছেন প্রথম সফরে। সেই ট্র্যাডিশান এবার আগেই ভেঙ্গেছে। শেখ হাসিনা প্রথম সফরে গেছেন থাইল্যান্ড। চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সফরেও প্রথমে দিল্লি যাচ্ছেন। কারণ দিল্লি ইদানিং এসব বিষয়ে বেশ ‘স্পর্শকাতরতা’ দেখাচ্ছে। লাদাখে বিশেষ করে গ্যালভান নদীর তীরে চীন-ভারত সংঘর্ষে ভারতীয় সেনারা নিহত হওয়ার পর স্পর্শকাতরতা বেড়েছে। তার ওপর মালদ্বীপে চীনপন্থী মুইজ্জার সরকার গঠিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালে চীনপন্থীদের উত্থানের কারণে ঢাকা-বেইজিং সামরিক সম্পর্ক দিল্লির দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফরের পর বিষয়টা খুবই দৃশ্যমান হয়েছে। ভারতে নির্বাচন চলাকালে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা সফরে এসে তিস্তায় একটি প্রকল্পের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে আটকে আছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় শুষ্ক মওসুমে পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। সেচের খুব সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি ওই অঞ্চলের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে ওঠায় বাংলাদেশ তিস্তায় ভিন্নমাত্রার একটি প্রকল্পের কথা চিন্তা করে। এই প্রকল্পের অধীনে রিজার্ভার তৈরী করে বর্ষাকালের পানি আটকে রাখা হবে। এই পানি শুস্ক মওসুমে ব্যবহার হবে সেচের কাজে। তিস্তার দুই তীরে গড়ে উঠবে বাণিজ্য। এই বড় পরিকল্পনায় এক বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন হবে যা চীন ঋত হিসাবে দেবার বিষয়টি বিবেচনা করবে। এমন আলোচনা চলাকালে ভারত বিষয়টাকে তার দেশের নিরাপত্তার জন্যে স্পর্শকাতর বলে মনে করা শুরু করেছে। দিল্লির মনে এই চিন্তাও ঘনীভূত হতে থাকে যে, শেখ হাসিনা এবার বেইজিং সফরে গেলে তিস্তার প্রকল্পটি নিয়ে কোনও চুক্তিও হয়ে যেতে পারে। তাই কোয়াত্রা তড়িঘড়ি ঢাকায় এসে তিস্তায় ভারত প্রকল্পটি করতে আগ্রহ প্রকাশের কথা জানান। ভারতের কোনও কোনও পক্ষ মনে করে, তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির জন্য ভারতকে চাপে ফেলতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা একটা কৌশল। আবার বাংলাদেশের কোনও কোনও মহল মনে করে যে, তিস্তায় চীনের অর্থায়ন বন্ধে দিল্লির প্রস্তাব একটি কৌশলমাত্র। দিল্লি এত বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না।
শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকে ভারত ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের ফল হিসাবে দেখা হচ্ছে। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত, শেখ হাসিনার সরকারকে মোদি ও শি উভয়েই নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে কেউ ছেড়ে যাচ্ছেন না। এই বাতাবরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারাও শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সুর নরম করেছেন।