শনিবার   ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ১৩ ১৪৩১   ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত তথ্য পাচার

হাসান মাহমুদ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৫৮ এএম, ১৫ জুন ২০২৪ শনিবার


ঘটনায় জড়িত র‌্যাব, পুলিশ ও সাইবার ক্রাইমের অন্তত ৪ জন

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রধারী হাজার হাজার নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। এই অপরাধে জড়িত পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের একজন এসপি এবং র‌্যাবে কর্মরত আরেকজন এসপিসহ তাদের সহযোগীরা এখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল।
হাজার হাজার মানুষের এই অতি স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত সব তথ্য চুরি হওয়ায় তারা এখন চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছেন। সাধারণ নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের এই সব ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল টাকার বিনিময়ে পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও এই নিরাপত্তা ঝুঁকির বাইরে নন বলে মনে করা হচ্ছে।
এই অপরাধে অভিযুক্ত দুই এসপির মধ্যে একজন হচ্ছেন নারী। ন্যাশনাল ইনফরমেশন পোর্টালে ঢুকে বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন কল এবং ব্যক্তিগত সংবেদনশীল বিভিন্ন তথ্য তারা গোপনে সংগ্রহ করেছেন এমন প্রমাণ পেয়েছে ‘এনটিএমসি’ কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুক গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থের বিনিময়ে ড্যাটা বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অপরাধে তাদেরকে বরখাস্তসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রক্রিয়া এখন চলমান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
তথ্য ফাঁস হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকরা অনেক ধরনের সমস্যার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে ১১ জুন, মঙ্গলবার র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও এনটিএমসি’র বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনে জানিয়েছেন, ‘অভিযুক্তদের বিষয়ে এনটিএমসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে সব কিছু জানানো হয়েছে। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর পর্যবেক্ষণে অভিযুক্তদের এই দুষ্কর্মের ঘটনা ধরা পড়েছে।’
উল্লেখ্য, ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৮ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ‘ডিজিএফআই’ ভবনে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে সরকারী বিভিন্ন সংস্থাকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে। তেমনই এক গোয়েন্দা নজরদারিতে তারা দেখতে পান যে, ন্যাশনাল ইনফরমেশন পোর্টাল (এনআইপি)-এ ঢুকে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ড্যাটা সংগ্রহ করেছেন পুলিশের অ্যান্টি টেররিজমে এবং র‌্যাবে কর্মরত এসপি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা। ‘এনটিএমসি’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।
এনটিএমসির ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান জানান, ‘সংবেদনশীল তথ্য সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেউ এমনটা করলে সে সব ঘটনা জানার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এনটিএমসি’র রয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, অন লাইন মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের বিভিন্ন গ্রুপ ও চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের ক্লাসিফাইড তথ্য বিক্রি করে দিয়েছেন পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিটিআরসি, এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মনিটরিং করার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘এনটিএমসি’ কাজ করে থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা অস্বাভাবিক ড্যাটা সংগ্রহ করায় তাদের ওপর নজর রাখতে থাকে এনটিএমসি। তাতে দেখা যায়, পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) কর্মকর্তা পুলিশ সুপার ফারহানা ইয়াসমিন এবং র‌্যাব-এর কর্মকর্তা পুলিশ সুপার তারেক আমান বান্না বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) অত্যন্ত গোপনীয় ও স্পর্শকাতর সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন। নিজেদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে তারা জাতীয় সার্ভারে ঢুকে অস্বাভাবিক লগ ইন করছেন বলে দেখতে পায় এনটিএমসি। সেখান থেকে পরিচয়পত্রের তথ্য ও কল রেকর্ড চুরি করে অর্থের বিনিময়ে সেগুলি পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে।
পুুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, গত ২ মে এনটিএমসিকে লেখা এক চিঠিতে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন যে, ‘সাইবার ক্রাইম উইংয়ের মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র রায় এবং অপারেশন উইংয়ের খায়রুল ইসলাম কল ডিটেল রেকর্ডসহ স্পর্শকাতর তথ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। জিজ্ঞাসাবাদে তারা তা স্বীকারও করেছেন।’ বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র এনআইডির বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করার কারণে এনটিএমসি তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। সরকারী বিভিন্ন সেবা এবং তদন্ত কাজে অন্যান্য কর্মকর্তাদের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে ‘এনআইপি’র ওই পোর্টালে প্রবেশ করতে পারেন। এনআইপিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যক্তিগত তথ্য এবং কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) সংরক্ষিত থাকে।
নিজের পাসওয়ার্ড দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করার পর অস্বাভাবিক পরিমাণ ড্যাটা সংগ্রহ করতেন অভিযুক্তরা।
উল্লেখ্য, জাতীয় ওই সার্ভারে ঢুকে সরকারী ৪২টি সংস্থার ৫ শতাধিক কর্মকর্তার কাজ করার অনুমতি রয়েছে। সেই সুযোগ ব্যবহার করেই সেখান থেকে তথ্য নিয়ে টাকার বিনিময়ে তা পাচার বা বিক্রি করার অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।  
তথ্য পাচারের এই ভয়াবহ ঘটনা নিশ্চিত হবার পর এনআইপিতে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট ও র‌্যাব-৬ এর প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এদিকে র‌্যাব থেকে জানানো হয়, পুলিশের ওই এসপিকে ক্লোজড করা হয়েছে এবং বিভাগীয় তদন্ত চলমান রয়েছে।
গত বছরের ৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো বেইজড টেক ক্রাঞ্জ থেকে জানানো হয়েছিল বাংলাদেশে সরকারী ওয়েবসাইট থেকে পাঁচ মিলিয়ন নাগরিকের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে একটি চক্র। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।