শনিবার   ৩০ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলাদেশ-মিয়ানমান মুখোমুখি

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫৭ এএম, ২২ জুন ২০২৪ শনিবার

জান্তা ও আরাকান আর্মিকে ঢাকার হুঁশিয়ারি
গুলি পড়লে পাল্টা গুলি করা হবে


 

বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিয়মিত সামরিক বাহিনী এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। রাখাইনে স্থলভাগের বড় অংশ আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে মংডু অঞ্চলটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে নাফ নদী, টেকনাফ সীমান্ত এবং জলভাগ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জলভাগে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ শহর সিতওয়ের নিয়ন্ত্রণও আরাকান আর্মির হাতে চলে যাবে। এমন আশঙ্কায় বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের কাছে মিয়ানমারের জলসীমায় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে দেশটির নৌবাহিনী। সেন্টমার্টিনের কাছে বাংলাদেশের জাহাজ লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এতে করে সেন্টমার্টিনে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বিষয়টির কড়া প্রতিবাদ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরকান আর্মি উভয়কে জানিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশে গুলি পড়লে পাল্টা গুলি করা হবে।
বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) এবং সমুদ্রসীমায় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থায় আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি উভয়কে আমরা জানিয়ে দিয়েছি যে, আমাদের সীমানায় গুলি হলে আমরা পাল্টা গুলিবর্ষণ করবো। সেন্টমার্টিনের কাছে আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে তারা যুদ্ধ সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছে। সেন্টমার্টিনে খাদ্য সরবরাহসহ নৌ-চলাচল শুরু হয়েছে’।
বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে সমুদ্রপথে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও, বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমুদ্রপথে সেন্টমার্টিন বেড়াতে যান। বাংলাদেশের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিবদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যৌথ অপারেশন্স পরিচালনা করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির এই সংঘর্ষের কারণে নাফ নদী এবং নদী সংলগ্ন মোহনা এলাকায় বাংলাদেশী বোটের উপর অনাকাঙ্খিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১২ জুন প্রতিবাদ জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমার নৌবাহিনী সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থানকরতঃ মিয়ানমারের দিকে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষন করছে। একই সাথে আরাকান আর্মিও মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে।
আইএসপিআর আরও বলেছে, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ উক্ত অপারেসন্স পরিচালনা করছে। মিয়ানমার নৌ বাহিনী সেন্টমার্টিন্সের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় অবস্থানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে অবহিত করছে। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষটি মিয়ানমারের মূল ভূখন্ড এবং তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় চলমান রয়েছে। আরও উল্লেখ্য যে, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের সন্নিকটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের একাধিক জাহাজ মিয়ানমারের জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় থেকে নিয়মিত টহল পরিচালনা করছে।
আইএসপিআর এও বলেছে যে, মিয়ানমারের চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ সেন্টমার্টিন্সের নিকটবর্তী হওয়ায় উক্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্টমার্টিন্সের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্নেষী মহল কর্তৃক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সকলকে এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে আইএসপিআর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দশা অনেকটা বাঘের পিঠে বসার মতো। ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি অং সান সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলে নেয় সামরিক জান্তা। বাঘের পিঠ থেকে যেমন কেউ নামতে পারে না; মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দশাও এখন এমনই। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা সুসংহত করতে গিয়ে দমন পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। সু চি’র এনএলডি কর্মীদের ধর-পাকড়ের পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের অর্ধেকের বেশি বামার জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা মূলত সু চি’কে সমর্থন করে থাকেন। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। দেশটির বেশিরভাগ সময় সামরিক বাহিনী শাসন করেছে। গণতান্ত্রিত প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে সু চি কিছু সময় দেশের নেতা থাকলেও নিরাপত্তার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর হাতেই ছিল। গণতান্ত্রিক আমলে পার্লামেন্টে সামরিক বাহিনীর সংরক্ষিত আসন রয়েছে। ওই সময়ে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। এখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বামাররা অনেকে লড়াই করলেও তারা আবার সীমান্তবর্তী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভাগাভাগির কোনও কিছু মেনে নিতে পারে না। ফলে রাখাইনে কিংবা কাচিন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বামাররা একত্রে লড়াইয়ে যেতে নারাজ। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্য এবং পাশর্^বর্তী ভারত ও চীনের সীমান্ত সংলগ্ন কাচিন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে ‘ত্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করেছে। এতে করে আরাকান আর্মি সাহস সঞ্চার করে যুদ্ধ করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ফলে মিয়ানমার আর্মির অনেকে আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার এদেরকে মিয়ানমারের সরকারের কাছে নিরাপদে ফিরিয়ে দিচ্ছে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে সমুদ্রপথে এদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যে স্থলভাগে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অবস্থা নাজুক। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিমান ও সমুদ্রপথে অভিযান পরিচালনা করছে। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নৌপথে ও বিমানপথে অভিযান পরিচালনার আগে বাংলাদেশকে জানিয়ে দিচ্ছে। কারণ তারা বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তবে আরাকান আর্মি স্থলভাগে গুরুত্বপূর্ণ মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর এবার জলপথ দখলের মাধ্যমে আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর সিতওয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে বদ্ধপরিকর। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং আরাকান আর্মি উভয়ে চীনের সমর্থনপুষ্ট। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসে চিঠি পাঠিয়ে এবং ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনোয়ার হোসেন মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমানা সংলগ্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মিয়ানমারকে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের জাহাজে গোলাবর্ষণের ঘটনায় মৌখিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করে মিয়ানমারের জান্তা। জান্তার একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের জাহাজ লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ মিয়ানমারের নৌবাহিনী করেনি। আরাকান আর্মি করেছে। আরাকান আর্মিকে কীভাবে বাংলাদেশ সতর্ক করেছে সে সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কিছুই বলেননি। তবে বাংলাদেশ নিজ ভূখন্ডের নিরাপত্তার স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনও আপত্তি নেই বলে জানা গেছে।