গাজা সংঘাতের মধ্যেই ইসরাইলে রকেট-বিস্ফোরক রপ্তানি করছে ভারত
নিউজ ডেস্ক
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১৫ পিএম, ২৬ জুন ২০২৪ বুধবার
নুসেইরাত আশ্রয়শিবিরে ৬ জুন ইসরাইলি বাহিনী বোমা হামলা চালায় ফিলিস্তিনে। এবিষয়ে কুদস নিউজ নেটওয়ার্ক একটি ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে ইসরাইলি যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়। ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষে পরিষ্কারভাবে একটি লেবেল দেখা যায়, যেখানে লেখা ছিল, ‘মেইড ইন ইন্ডিয়া (ভারতে নির্মিত)।’
বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা।
গত ১৫ মে ভোরে স্পেনের কার্তাহেনা বন্দরের উপকূলে মালবাহী জাহাজ বোরকাম এসে পৌঁছায়। বন্দর থেকে অল্প দূরে সমুদ্রে অবস্থানরত এই জাহাজের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে স্পেনের জনগণ। তাদের দাবি, এই জাহাজে করে ইসরাইলের জন্য অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে এই 'সন্দেহজনক' জাহাজ পরিদর্শন করার আহ্বান জানায়।
তবে স্পেন সরকার কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই স্পেনের বন্দরে থামার পরিকল্পনা বাতিল করে স্লোভেনিয়ার বন্দর কোপারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায় বোরকাম নামের জাহাজটি। এতে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
আল জাজিরার হাতে কিছু নথি এসেছে, যা থেকে জানা গেছে এই জাহাজটিতে ভারত থেকে নিয়ে আসা বিস্ফোরক উপকরণ বোঝাই করা ছিল এবং এর শেষ গন্তব্য ছিল ইসরাইলি বন্দর আশদোদ, যা গাজা উপত্যকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।
মেরিন ট্র্যাকিং সাইটের তথ্য থেকে জানা গেছে, জাহাজটি ২ এপ্রিল চেন্নাই থেকে ছেড়ে আফ্রিকার পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে। লোহিত সাগরে হুথিদের সম্ভাব্য হামলা এড়াতে এই বিকল্প পথে যায় জাহাজটি।
এসব নথি অনানুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রহ করেছে সলিডারিটি নেটওয়ার্ক এগেইন্সট দ্য প্যালেস্টিনিয়ান অকুপেশান (রেসকপ)। নথি থেকে জানা গেছে, বোরকাম জাহাজে ২০ টন রকেট ইঞ্জিন, সাড়ে ১২ টন বিস্ফোরক-যুক্ত রকেট, দেড় হাজার কেজি বিস্ফোরক এবং ৭৪০ কেজি চার্জ ও কামানের প্রপেলান্ট বোঝাই করা হয়েছিল।
গোপনীয়তা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব কর্মী, উপদেষ্টা বা অন্যান্য ব্যক্তিরা যেন কোনো পরিস্থিতিতে আইএমআই সিস্টেমস অথবা ইসরাাইলের নাম উল্লেখ না করে। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস ২০১৮ সালে প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান আইএমআই সিস্টেমসকে কিনে নেয়।
জাহাজটির বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে জার্মান প্রতিষ্ঠান এমএলবি ম্যানফ্রেড লতারজুং বেফ্রাখতুং। প্রতিষ্ঠানটি আল জাজিরাকে জানিয়েছে, জাহাজে এমন কোনো অস্ত্র বা মাল বোঝাই করা হয়নি যেটার গন্তব্য ইসরাইল।
ভারত ছেড়ে আসা দ্বিতীয় একটি জাহাজ ২১ মে কার্তাহেনা বন্দরে এসে পৌঁছালেও নোঙর করার অনুমতি পায়নি। স্পেনের পত্রিকা এল পাইস জানায়, মারিয়েন দানিকা নামের জাহাজটি চেন্নাই ছেড়ে এসেছিল এবং এটি ২৭ টন বিস্ফোরক নিয়ে ইসরাইলি বন্দর হাইফার উদ্দেশে যাত্রা করছিল।
স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে মানুয়েল আলবারেস এক সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেন, ইসরাইলের জন্য সামরিক পণ্য বহনকারী জাহাজটিকে স্পেনের বন্দরে ভিড়ার অনুমত দেওয়া হয়নি। এসব ঘটনা থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভারত ইসরাইলের কাছে অস্ত্র রপ্তানি করছে, যা দেশটির 'সামরিক উদ্যোগ নয়, সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের' পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থি।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাবের কারণে এ ধরনের লেনদেন সম্ভব হয়ে থাকতে পারে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) গবেষক জেইন হুসেন আল জাজিরাকে বলেন, যাচাই করার মতো তথ্যের অভাবে এ ধরনের লেনদেন আদৌ ঘটেছে কী না, তা নিশ্চিত করে বলা খুবই কঠিন।
‘তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরাইল ও ভারতের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে, তাই ভারতীয় অস্ত্র বা উপকরণ ইসরাইলের হাতে এসে পৌঁছানোর এবং তা গাজায় ব্যবহার অসম্ভব কিছু নয়।’
জেইন হুসেন জানান, এই ভিডিওটি আরও ভাল করে যাচাই করা প্রয়োজন। তবে তিনি জানান, এ বিষয়টি সর্বজনবিদিত যে ইসরাইল-ভারত ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনে একে অপরকে সহযোগিতা করছে।
সিপরি আরও জানিয়েছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভস লিমিটেড সলিড প্রপেলান্ট নির্মাণ করে। এটি রকেট মোটরের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। এমআরস্যাম ও এলআরস্যাম ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে এর চাহিদা রয়েছে।
ইসরাইলি নকশায় নির্মিত মধ্যম ও দূরপাল্লার বারাক সারফেস-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে এই যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয়।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক টি. চৌধুরী ৩১ মার্চ একটি কনফারেন্স কলে ইসরাইলের কাছে গাজায় যুদ্ধ চলাকালীন সময় পণ্য রপ্তানির বিষয়টি স্বীকার করেন।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা ইসরাইলি রপ্তানি অর্ডারের বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এবং এ কারণে এই প্রান্তিকে আমাদের রাজস্ব অনেক বেড়েছে।
এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক মিটিং মিনিটসে তার এই বক্তব্যের উল্লেখ আছে। ঐ বৈঠকে চৌধুরী দাবি করেন, প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভ লিমিটেড হচ্ছে ‘একমাত্র ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যারা পুরোপুরি অ্যাসেম্বল করা রকেট মোটর রপ্তানি করছে।’
তিনি আরও জানান, তার প্রতিষ্ঠান মাইন-গোলাবারুদ উৎপাদন শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে আরডিএক্স ও এইচএমএক্স বিস্ফোরক রপ্তানি শুরু করেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করে, তারা ইসরায়েলের ‘প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ’ খাতের রপ্তানিকারক। সিপরির মতে, বারাক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রোপেলান্ট রপ্তানির কারণেই তাদের এই ঘোষণা। এ বিষয়ে প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি আল জাজিরা।
ভারতের ড্রোন
ইসরাইলের সঙ্গে শুধু রকেট প্রোপেলান্ট নয়, ড্রোন নিয়েও লেনদেন রয়েছে ভারতের। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ও ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমসের যৌথ উদ্যোগে হায়দ্রাবাদে ড্রোন উৎপাদন কারখানার উদ্বোধন হয়।
উদ্বোধনের সময় দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, এই প্রথম ইসরায়েলের বাইরের কোনো অবস্থানে হারমেস ৯০০ মডেলের ড্রোন উৎপাদন করা হবে, যেটি ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায় একবারে ৩৬ ঘণ্টা চলতে সক্ষম।
এ বছরের শুরুতে ভারত তাদের প্রথম নিজস্ব 'দৃষ্টি ১০ স্টারলাইনার' ড্রোনের ঘোষণা দেয়, যেটি হারমেস ড্রোনের নকশায় নির্মিত।
সিপরি জানিয়েছে, এ মুহূর্তে হায়দ্রাবাদের কারখানায় ইসরায়েলি রপ্তানির জন্য ড্রোন উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে ভারত এ বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। গাজার যুদ্ধে ইসরায়েল অসংখ্য ড্রোন ব্যবহার করেছে।
এলবিটের উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোসেফ গ্যাসপার জানান, তার প্রতিষ্ঠান ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর চাহিদা মেটাতে সপ্তাহে সাত দিন ও দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
গাজার আকাশে ইসরাইলি হারমেস ড্রোন দেখার মানেই এটা নয় যে সেটা ভারত থেকে এসেছে, কারণ ইসরাইল নিজেও এ ধরনের ড্রোন উৎপাদন করে, যোগ করেন জেইন হোসেন। আদানি গ্রুপ জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের কাছে ড্রোনের ছোট চালান পাঠালেও এগুলোতে কোনো মারণাস্ত্র সংযুক্ত করা নেই।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, আমরা আবারও জানাচ্ছি- এসব ড্রোন নজরদারির কাজের জন্য। এগুলো কোনো হামলায় ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ৭ অক্টোবরের পর আমরা ইসরাইলের কাছে কোনো ড্রোন রপ্তানি করিনি।