চরম চাপে অর্থনীতি
ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশ
আবু সাইম
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪০ এএম, ২৯ জুন ২০২৪ শনিবার
ঋত করে ঋত শোধ
রিজার্ভ কমে ১২.৮ বিলিয়ন ডলার
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে অদক্ষতায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋত নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করেছে। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় সরকারের ঋত ও ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকারকে ঋত করেই আগের ঋত পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেকই ঋণের সুদ-আসলে ব্যয় হচ্ছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ইআরডির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সরকার ১১ মাসে (জুন-২৩ থেকে মে-২৪) ৭০২ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋত-অনুদান পেয়েছে। এর মধ্যে ৬৬১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার ঋত, বাকি ৪০ কোটি ৫১ লাখ ডলার অনুদান। তবে বিদেশ থেকে পাওয়া এ অর্থের প্রায় ৪৪ শতাংশই আগের নেওয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হচ্ছে। গত ১১ মাসে ঋত পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারের। বছরের ব্যবধানে এ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময় ঋত শোধের পরিমাণ ছিল ২৪৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার। বছরের ব্যবধানে ঋত শোধের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬০ কোটি ডলার।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ঋত পরিশাধের এ প্রক্রিয়াকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ঋত করে ঋত শোধ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে 'বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋত ও ঋত পরিশোধের সক্ষমতা' বিষয়ক প্রবন্ধে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ের কারণে ঋত পরিশোধের জন্য ক্রমাগত নতুন ঋত নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ঋত ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋত ও ঋত পরিশোধের দায়বদ্ধতার দ্রুত বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। দিনে দিনে ঋণের শর্তাবলী আরও কঠোর হচ্ছে।
ইআরডির পরিসংখ্যান বলছে, পরিশোধিত ঋণের মধ্যে আসল হিসেবে শোধ দিতে হয়েছে ১৮১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, আর সুদ ১২৫ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। বছরের ব্যবধানে সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৩৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৪২ শতাংশ। গত বছরের একই সময় সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ৮৮ কোটি ডলার।
এদিকে চলতি বছর সরকার মোট ১৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋত নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। ১১ মাসে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ছাড় হয়েছে। লক্ষ্য পূরণে এই জুনেই ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ছাড়ের আশা করছে সরকার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋত পেতে বিভিন্ন শর্ত মানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হচ্ছে। এসব শর্ত অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে তুলছে। সর্বশেষ এক দিনে ডলারের দাম সাত টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ডলারের এই দর বৃদ্ধিতে চাপ তৈরি হয়েছে বিদেশি ঋত পরিশোধে। টাকার এ অবমূল্যায়নের ফলে এক দিনেই বৈদেশিক ঋত ৭০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসায়ও আরেক চাপ তৈরি হয়েছে।
সোমবার বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এর পরপরই বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে ১১৮ পৃষ্ঠার মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এপ্রিলের শেষে বাংলাদশের নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) কমে ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ২০২৩ সালের জুন শেষে যা ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে ২.৯ মাসের আমদানি ব্যয় মোটনো যেত। ১০ মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ৬ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে দেড় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। অথচ ২০২২ সালের জুনেও বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ২৮ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে সম্ভব ছিল ৪.২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো। সার্বিক বিবেচনরায় বাংলাদেশের আমদানি সক্ষমতাও দিন দিন কমছে।
আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অংকে ঋণের চাপ অনেক বেড়েছে। ২০২২ সালের শুরুতে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৬.২০ টাকা। বর্তমানে সরকারি হিসাবে এক ডলারের দাম ১১৭ টাকা। দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৩০ টাকার বেশি। অর্থাৎ টাকার অংকে বৈদেশিক ঋত দুই বছরেই বেড়েছে ৩০ শতাংশ। মাত্র দুই বছর আগেও বাজারভিত্তিক ঋত নিয়ে তেমন চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। তখন সুদের হার ছিল ১ শতাংশের মতো। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সুদহার শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ শতাংশে। এদিকে বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের ঋত পরিশোধের সময় শুরু হওয়ায় আগামী বছরগুলোতে ঋণের চাপ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।