রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪   আষাঢ় ২৩ ১৪৩১   ৩০ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

ফিলিস্তিনি শিশু সেই হিন্দ রজবের বাবাও গাজায় নিহত

নিউজ ডেস্ক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৮:০২ পিএম, ২ জুলাই ২০২৪ মঙ্গলবার

ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি হিন্দ রজবের বাবাকেকেও গাজায় হত্যা করা হয়েছে। হিন্দ রজব গত জানুয়ারিতে ইসরায়েলি ট্যাংক হামলায় নিহত হলে এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

মার্কিন সাংবাদিক জেরেমি স্কাহিল এক্স-এর একটি পোস্টে জানিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা আশরাফ মাশহারাভির কাছ থেকে হিন্দের বাবার মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন। আশরাফ হিন্দের মায়ের কাছ থেকে এই মৃত্যুর খবর জানতে পান।

ইসরায়েলের চলমান হামলায় হিন্দের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এর পরেই ফোনে একটি বর্তার মাধ্যমে হিন্দের মা জানতে পারেন, তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ইসরায়েলি ট্যাংকের ওই আক্রমণে হিন্দসহ তার তিন চাচাতো ভাই, তার খালা এবং চাচাও নিহত হয়েছিল। হিন্দকে উদ্ধারের জন্য পাঠানো দুই ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট প্যারামেডিকও নিহত হয়েছিল ওই হামলায়।

সেদিন শিশু হিন্দের কথা শুনে গা হিম হয়ে গিয়েছিল প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ইমার্জেন্সি কল সেন্টারের কর্মী রানা ফকিহর। কথা বলার সময় নিজের কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন তিনি। হিন্দ বারবার বলছিল, ইসরায়েলি ট্যাংক খুব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু আতঙ্কে জমে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটিকে সাহস দিতে তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া ওই মুহূর্তে রানার কিছুই করার ছিল না।

হিন্দের চারপাশে পড়ে ছিল পরিবারের কয়েকজন সদস্যের লাশ। গত ২৯ জানুয়ারির দুপুরের দিকের ঘটনা। এলাকা ছাড়তে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হুমকি আর অনবরত গোলাগুলির মুখে হিন্দকে নিয়ে গাজার বাড়ি থেকে পালাচ্ছিল তার চাচার পরিবার। গাড়িতে ছিল হিন্দ, চাচা-চাচি ও তাঁদের পাঁচ সন্তান। হিন্দের মা উইসাম ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, তাদের এলাকায় প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছিল।

বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তারা নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। পরে আহলি হাসপাতাল নিরাপদ মনে করে সেখানে গিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। উইসাম বড় সন্তানকে নিয়ে হেঁটেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে ছোট হিন্দকে চাচার গাড়িতে তুলে দেন। ওদের গাড়িটি রওনা হওয়ার অল্প পরেই সেদিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান উইসাম। তার ধারণা, অপ্রত্যাশিতভাবে হিন্দের চাচার গাড়িটি ইসরায়েলি ট্যাংকের সামনে পড়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে গাড়িটি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় অবস্থিত প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্টের সদর দপ্তরে হিন্দের চাচার নম্বর থেকে একটি কল যায়। কল সেন্টার থেকে পাল্টা ফোন করা হলে ধরে হিন্দের চাচার ১৫ বছর বয়সী মেয়ে লায়ান। সে জানায়, তার বাবা-মা ও ভাই-বোনরা সবাই গুলিতে নিহত হয়েছেন। এখনো তাদের গাড়ির দিকে গুলি ছোড়া হচ্ছে। এক পর্যায়ে আরো গুলির শব্দ আর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় লায়ানের কণ্ঠস্বর।
 
পরে রেড ক্রিসেন্টের তরফ থেকে আবার ফোন করা হলে কলটি ধরে শিশু হিন্দ। অন্য প্রান্তের সবাই প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় গাড়িটির আরোহীদের মধ্যে একমাত্র হিন্দই বেঁচে আছে। এরপর বিপর্যস্ত মেয়েটিকে সাহস দিতে কয়েক ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যান রানা। বলেন, আসনের নিচে লুকিয়ে থাকতে। এর মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে ওই স্থানে যাওয়ার অনুমতি চায় রেড ক্রিসেন্ট। প্রায় তিন ঘণ্টা পর রেড ক্রিসেন্টের একটি অ্যাম্বুল্যান্স হিন্দকে উদ্ধারে রওনা হয়।

এক পর্যায়ে ইউসুফ ও আহমেদ নামের দুই রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ফোনে তাদের কার‌্যালয়ে জানিয়েছিলেন, তারা ঘটনাস্থলের একেবারে কাছেই। ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য তাদের তল্লাশি করতে আসছে। এটাই ছিল রেড ক্রিসেন্টের ওই দুই কর্মীর শেষ কথা। এরপর তাঁদের কোনো হদিশই মেলেনি। খোঁজ মেলেনি হিন্দেরও।

হিন্দের দাদা বাহা হামাদা বলেছেন, মায়ের সঙ্গে ওর কথা আরো কয়েক সেকেন্ড চলে। তখন মেয়েটি বলেছিল, সে দূরে অ্যাম্বুল্যান্সটা দেখতে পাচ্ছে। এ সময় হিন্দের গাড়ির দরজা খোলার শব্দও পান তার মা। তার পরই কেবল নীরবতা।
বিবিসিকে মা উইসাম বলেন, ‘প্রতিটা মুহূর্ত বুকটা যেন জ্বলে-পুড়ে যায়। অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ শুনলেই মনে হয় ওরা হিন্দকে নিয়ে আসছে। প্রতিটা গুলির আওয়াজ, প্রতিটা ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার শো শো শব্দ শুনলে মনে হয় আমার মেয়েটার গায়ে লাগবে না তো!’

আহলি হাসপাতালের সামনে বসে থাকতেন উইসাম। মেয়ে ফিরে আসবে সেই আশায়। বিবিসি, সিএনএন ও এএফপির তরফ থেকে ওই দিনের ঘটনা জানিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে হিন্দ ও দুই রেড ক্রিসেন্ট কর্মীর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলেও তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। এ ছাড়া সিএনএনকে ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা জানেই না।

এরপর সেই ঘটনার ১২ দিন পর ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে হিন্দ ও তার পাঁচ স্বজন এবং রেড ক্রিসেন্টের দুই ক্রু-র লাশ পাওয়া গেছে।  ইসরায়েলের বোমা হামলায় অ্যাম্বুলেন্সের দুই ক্রু ইউসুফ আল-জেইনো এবং আহমেদ আল-মাধউন নিহত হন বলে জানায় পিআরসিএস।