শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হাসিনার চীন সফর

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:০৮ এএম, ৬ জুলাই ২০২৪ শনিবার


যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ করছে যে, শেখ হাসিনার সরকার অতিমাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে আছে। সেখান থেকে সরাতে ওয়াশিংটন চেষ্টাও কম করেনি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়; গোটা পশ্চিমা দুনিয়া ঢাকা-বেইজিং ‘ডি কাপলিং’ তথা ছাড়াছাড়ির চেষ্টায় মত্ত। কিন্তু হাসিনার প্রশাসন ‘বিকল্প উইন্ডো’ চীনকে দূরে সরানোর এসব পরামর্শে কান দিচ্ছে না। তাদের মতে, বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হলে চীনকে পাশে চাই। কেননা উন্নয়ন না করলে সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থার ভাব তীব্র হতে পারে। তাছাড়া, সামরিক সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সংকটের অবসান কিংবা অনাকাঙ্খিত পশ্চিমা চাপের হাত থেকে সরকারকে সুরক্ষিত রাখতে চীনের কোনও বিকল্প নেই। তাই, বাংলাদেশের ফরেন পলিসির মূলমন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরীতা নয়’ নীতির আড়ালে বেইজিংকেও সমানভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে ঢাকা। এই সময়ে শেখ হাসিনার সফরে শি জিনপিং প্রশাসন খুবই উচ্ছ্বসিত। বেইজিংয়ে চীনা মুখপাত্র এবং ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত গতকাল বৃহস্পতিবার একযোগে শেখ হাসিনার সফরের ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেও এশিয়ার পরিস্থিতির প্রতি মার্কিন নজর খুবই প্রখর। বাইডেনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু সম্প্রতি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, মালদ্বীপে তারা কাজ করতে চান। ভারতকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চান। মালদ্বীপের স্থলভাগ কম হলেও বিশাল জলরাশি কোনওভাবেই ছোট নয়। এই জলভাগের নিরাপত্তায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। যদিও চীনপন্থী মুইজ্জার সরকার মালদ্বীপের ক্ষমতায় রয়েছে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতেও চীনকে অনিবার্যভাবে যুক্ত রাখতে হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে ক্রমশও চীনের প্রভাব বাড়তে থাকলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তবে চীন মনে করে, বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আর্বিভূত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৮০০ ডলার। আগামী পাঁচ বছরে এই আয় চার হাজার ডলারে উন্নীত হবে। এসব সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে অনাড়ম্বও আয়োজন।
তিস্তায় বর্ষাকালে নদীর পানি জমিয়ে রেখে সংরক্ষনারে রেখে তা শুকনার মৌসুমে সেচের কাজে লাগানোর পাশাপাশি নদীটির দুই তীরে নগর গড়ে উঠবে। এমন একটি ধারণা নিয়ে তিস্তায় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করবে বলে ধারণার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা দ্রুত ঢাকায় এসে তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আর এতেই সৃষ্টি হয়েছে বিপত্তি। বাংলাদেশ কাদেও অর্থায়ন গ্রহণ করবে তা নিয়ে বেকায়দা দশা। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের প্রকল্প। ফলে এই প্রকল্পে কাদের অর্থায়ন গ্রহণ করবে সেটা বাংলাদেশের নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। ভারতের হাইকমিশনারও একই কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই প্রস্তাব হলো, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন প্রকল্প। এর মাধ্যমে পায়রা বন্দর থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত গোটা উপকূল এবং দক্ষিণের জনপদে চীনের অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চীনারা বলছেন, এই ব্যাপারে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রকল্প প্রস্তাব দিলে বিষয়টি তাদের বিবেচনায় থাকবে। দক্ষিণাঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়টি এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করার বিষয় চীনের বিবেচনাধীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। চীনের সঙ্গেও ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বেশিরভাগ প্রকল্পই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহায়তা বিষয়ক। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণও উল্লেখ করার মতো। চীনারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থার সৃষ্টির মতো বিনিয়োগ করেছে চীন।
বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে সরানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে ঢাকার দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করে বাংলাদেশ। বাইডেন প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি জানানোর জন্যে নানামুখী পশ্চিমা চাপের মধ্যে আউটলুক ঘোষণা করে বাংলাদেশ। এ ব্যপারে সন্দিহান হয়ে ওঠে চীন। তবে চীনকে আশ^স্ত করা হয়েছে যে, ঢাকার ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি’তে পরিবর্তন আসবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কক্ষপথেও ঢুকছে না বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার চীন সফর হয়তো এই বিষয়ের আরও বেশি জোরালো বার্তা দেবে। দ্বিপক্ষীয় বিষয় শুধু নয়; অনেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও বাংলাদেশ ও চীন একযোগে কাজ করে। এক চীন নীতিতে বিশ^াসী বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মনে করে, তাইওয়ান হলো চীনের একটি প্রদেশ।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি পর্বত সমান। তারপরও বেইজিং চায়, বাংলাদেশ যেন চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে। এই বিষয়টি চীনের তরফে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করা হতে পারে। যদিও বাংলাদেশের কোনও দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি পঞ্চমবারের মতো চীন সফর। এই সফরে প্রকাশ্যে ও গোপনে কী হচ্ছে তা জানতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সক্রিয়।
এদিকে, মালদ্বীপে যখন ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন চরমে; ঠিক তখনই ঢাকায় বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়ায় এই দুইয়ের মধ্যে মিল খোঁজে পেয়েছে দিল্লি। যদিও বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জন করার কাজটা প্রায় অসম্ভব। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটা একটা রাজনৈতিক শ্লোগান ছাড়া কিছুই নয়। তবে কি বিএনপি এখন চীনপন্থী! এই প্রশ্নও সামনে এসেছে।