মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ১ ১৪৩১   ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের মানব পাচারের তথ্য

হাসান মাহমুদ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:৫২ এএম, ১৩ জুলাই ২০২৪ শনিবার

স্টেট ডিপার্টমেন্টে‘টিআইপি হিরো’ অ্যাওয়ার্ড

 

মানব পাচারের ঘটনা বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলছে সেদিকে দৃষ্টি রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘টিআইপি হিরো’ অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, হাজার হাজার বাংলাদেশি মানব পাচারের শিকার। মানব পাচারকারীরা ফাঁদে ফেলার জন্য অনলাইন কৌশল অবলম্বন করছে। তিনি বলেন, তাদেরকে ধরার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বের এমন ১০ ব্যক্তিকে এবার ‘টিআইপি হিরো’ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হচ্ছে যারা নিজ নিজ দেশে মানব পাচার (হিউম্যান ট্র্যাফিকিং) প্রতিরোধে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন অন্যতম। বাংলাদেশ থেকে আল আমিন নয়নকে পাচারকারীরা বিদেশে নিয়ে জিম্মি করেছিল। এক সময় তারা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখান থেকে তিনি পালিয়ে দেশে ফিরে গত ১৫ বছর ধরে তিনি মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করে চলেছেন। তিনি এ পর্যন্ত পাচার হওয়া ৩৫ হাজার বাংলাদেশিকে সহযোগিতা দিয়েছেন। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে আসা বাংলাদেশের আল আমিন নয়নের হাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন ‘টিআইপি হিরো’ অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে ব্লিংকেন বলেন, বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন ২০০৭ সালে পাচারকারীদের শিকার হয়ে এক দু:খজনক জীবন কাটান। বন্দী অবস্থা থেকে ফিরে এসে পাচার হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করেছেন আল আমিন নয়ন। ব্লিংকেন বলেন, তার এই কাজের জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি তার কাছে আজ কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, পাচারকারীদের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশের আল আমিন নয়নের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। বেসরকারী খাত, নাগরিক সমাজ, বহুজাতিক সংস্থা এবং বেঁচে ফেরা মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হবে যারা জটিল চ্যালেঞ্জটি বুঝে। মানব পাচার এমন একটি সমস্যার নাম যা কোন একটি জাতি একা সমাধান করতে পারবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচার রিপোর্ট ‘টিআইপি’ প্রকাশ করে অ্যান্থনি ব্লিংকেন বলেন, মানব পাচারে জড়িত দুষ্কৃতকারীরা তাদের পদ্ধতিগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। মানব পাচারের প্রবণতা এবং কৌশল ধরার জন্য মেশিন লার্নিং উদ্যোগের বিকাশ ঘটানো হয়েছে। দেশে দেশে মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্টেট ডিপার্টমেন্ট অন্যান্য সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন আয়োজিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আল আমিন নয়ন বাংলাদেশ থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসেছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে এক টেলিফোন আলাপে আল আমিন নয়ন সাপ্তাহিক আজকালকে বলেন, আমি কোনদিন কল্পনাই করিনি এত বড় কোন অ্যাওয়ার্ড পাব। এই প্রাপ্তি ভাষায় বোঝানো যাবে না। আমেরিকায় এবারই আমার প্রথম সফর। ওয়াশিংটনে যাওয়ার পর ইউএস অ্যাম্বেসেডর অ্যাট লার্জ এন্ড ট্র্যাফিকিং ইন পার্সন সিন্ডি ডায়ার আমার অতীত ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়ে যান। তিনি কমপক্ষে পঞ্চাশ মিনিট ধরে আমার বিভীষিকাময় জীবনের ঘটনা শোনেন। রাজশাহীর গোদাগাড়িতে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। টানাপোড়নের সংসার। জীবিকার সন্ধানে ২০০৭ সালে আমি একটি গ্রুপের মাধ্যমে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কোন কাজ পাইনি। এক রাতে কাজের কথা বলে তারা আরেকটি গ্রুপের কাছে আমাকে তুলে দেয়। পরে জানতে পারলাম প্রথম গ্রুপ আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে একটি তামিল গ্রুপের কাছে। রাতে তারা আমার মতো আরও কয়েকজনকে নিয়ে রওনা দেয়। গভীর রাতে আমাদের গাড়ীটি একটি গহীন জঙ্গলের পাশে গিয়ে থামে। হাত বাধা অবস্থায় হাঁটতে হয়েছে অনেক দূর। সেখানেই মানব পাচারকারীদের একটি সেলে আমি সাত মাস বন্দী থেকে নির্যাতিত হয়েছি। আল আমিন নয়ন ফোনে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাকে অফিসে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সেখানে তার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
আল আমিন নয়ন ‘আজকাল’কে আরও জানান, বাংলাদেশে মানবপাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। তা তিনি জানতেন না। প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় গত ডিসেম্বরে পুলিশ বিমানবন্দর থেকে তাকে ধরে আদালতে হাজির করলে বিচারক তাকে ঢাকার কেরানিগঞ্জের কারাগারে পাঠান। সেখানে ৮ দিন জেল খেটেছেন আল আমিন নয়ন।
উল্লেখ্য, বিশ্বে মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সন’ (টিআইপি) রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। গত ২৪ জুন প্রকাশিত টিআইপি’র এবারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গত দুই দশকে মানব পাচারের বৈশ্বিক প্রবণতা এই রিপোর্টে পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পাচার হওয়া ২৭ মিলিয়ন মানুষকে দুই দশকে শ্রম ও বাণিজ্যিক যৌনতার কাজে ব্যবহার করেছে দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী’।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার নির্মূলের জন্য ন্যূনতম মানগুলি সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করে না। সরকার এই প্রথমবারের মতো পাচারের শিকার হওয়াদের ক্ষতিপূরণ তহবিলে অর্থ জমা করেছে। মানব পাচার করে দেশে বিদেশে বিক্রি করে থাকে অপরাধীরা। অপরাধমূলক জোরপূর্বক যৌন কাজে জড়িতদের মোকাবেলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। বরং মানব পাচারকে অভিবাসী চোরাচালানের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে ১০ শতাংশেরও কম নারী স্বেচ্ছায় বাণিজ্যিক যৌন পল্লিতে যেয়ে থাকে।’
রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মানব পাচারকারী নেটওয়ার্কগুলি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে, গেমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অন লাইনে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মানব পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের ফাঁদে ফেলার জন্য অন লাইন ব্যবহার করে। তাদের ধরার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ বছর বিশ্বজুড়ে মানব পাচার বিরোধী তৎপরতার জন্য দশ দেশের ১০ জনকে ‘টিআইপি হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করেছে। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, স্পেন, বলিভিয়া, কেনিয়া, ইরাক, সার্বিয়া, মালি, কিউবা এবং জাম্বিয়া। তাদের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশের আল আমিন নয়ন ছিলেন একজন ভিকটিম। আল আমিন নয়ন মানবপাচার বিরোধী কাজ নিয়ে ঢাকায় ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।