শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হাসিনার সামনে নানা চ্যালেঞ্জ

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৪৫ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২৪ শনিবার



চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকার শুরুতেই বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে বেগ পেতে হয়নি। এমনকি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার পরও বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে যুৎসই আন্দোলন করতে পারেনি। কিন্তু দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে নানা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে সরকার। আগের তিন মেয়াদে এমন চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি। সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারের কৌশল কী সেদিকেই এখন সবার নজর। এখন পর্যন্ত খুব জোরদার কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বেশ কিছু বড় বড় দুর্নীতির চিত্র সামনে আসায় সরকারের অবকাঠামোর উন্নতি ম্লান হয়ে পড়েছে। সরকার পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল, সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেও এখন একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের আমলাদের দুর্নীতির চিত্র দেখে সবাই হতবাক হয়ে পড়েছে। কোভিড মহামারীকালে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। দুর্নীতির ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশের রেকর্ড খুব খারাপ। বাইডেন প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু সম্প্রতি বাংলাদেশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তার আশ^াস দিয়েছেন। আমলাদের দুর্নীতির খবরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের ওপর ভর করে দুর্নীতিবাজ আমলারা নব্য আওয়ামী লীগ সেজে দুর্নীতি করছে। আর তার জন্যে সরকারের বদনাম হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু কিছু মামলা দায়ের করছে বটে; কিন্তু সর্বগ্রাসী দুর্নীতির থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করার মতো দক্ষ লোকবল বর্তমানে দুদকের নেই। তাছাড়া, দুদকের কাছ থেকে অনেক অভিযুক্তই ক্লিন সনদ পেয়েছেন। ফলে বর্তমানে বড় বড় দুর্নীতিবাজদের বিচার করে তাদের শাস্তির মুখোমুখি করানো কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় দূর হচ্ছে না। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির এক থেকে দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিদেশী বিনিয়োগ কম হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, ন্যায়-নীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। উন্নয়নের সুফল মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না।   
এই সরকারের আমলে অর্থনৈতিক সংকটই সবচেয়ে বড় আকারে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেটে কৃচ্ছতা সাধনের প্রতি জোর দেয়া হলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শাক-শব্জি থেকে শুরু করে প্রতিটি নিত্য পণ্যের দাম আকাশচুম্বি। ডলারের দাম বেশি থাকায় বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়েও রিজার্ভে চাপ পড়েছে। তাছাড়া, কোভিডের মহামারির পরবর্তি সময়ে বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কিছুটা কমেছে। পোশাক রফতানিও কমেছে। এসব কারণে অর্থনীতির ওপর চাপটা অনেক বেশি পড়েছে। এছাড়াও, ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের চাপ এত বেশি বেড়েছে যে, সেখানেও দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও, লুটেরারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অগ্রগতি হচ্ছে না। ব্যাংকিংখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো কীভাবে সম্ভব সেটাই বড় সমস্যা।
বর্তমান সরকারের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বড় শক্তিগুলির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক কখনই ভাল হয়নি। চীন ও ভারত বরাবর এই সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে রেখেছে। এই দুই আঞ্চলিক বড় দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ দুইটি সফর করেছেন। কিন্তু দুই দেশই ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশেষ করে তিস্তার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও চাপ দিচ্ছে চীন থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরাতে। এসব ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বাংলাদেশকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান বাড়ানো। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু ঘুষ, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেই মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের পথ ক্রমেই সংকোচিত হচ্ছে। যেসব কর্মী যাচ্ছেন তাদের উপযুক্ত ও দক্ষ করে পাঠানো হচ্ছে না। ফলে তারা খুব বেশি বেতনে চাকুরি পাচ্ছেন না।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা বাংলাদেশের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতি বছর ছয় লক্ষ মানুষ গৃহহারা হচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর একটি বড় ধাক্কা আসবে। জলবায়ুর অভিঘাত মুক্ত হতে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
উন্নয়নের প্রবাহকে ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা যাচ্ছে। মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যাচ্ছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যে অর্থ জোগান দেওয়া কঠিন কাজ। এমনিতেই বাংলাদেশ বিদেশী ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে আছে। আরও ঋণ পাওয়া সহজ নয়। খাদ্য নিরাপত্তা ও জ¦ালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও কঠিন। চাহিদা বাড়ছে প্রতিদিন। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। ব্যয় বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফেরানো চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা যাচ্ছে। এছাড়ও, গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে রেকর্ড ভাল করার মাধ্যমে সুনাম বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।