শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৪ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সরকারি প্রজ্ঞাপন

নিষিদ্ধ হলো জামায়াত-শিবির

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৮ এএম, ৩ আগস্ট ২০২৪ শনিবার



জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির এবং তাদের অপরাপর সকল অঙ্গ-সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে স্বাধীনতা বিরোধী দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর ফলে আগের নয়টি নিষিদ্ধ দলের সঙ্গে যুক্ত হলো জামায়াত-শিবিরের নাম। তারা এখন আর কোনও কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারবে না। জামায়াতের নিবন্ধন আগেই বাতিল ছিলো। ফলে এই দলের নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব ছিলো না। এখন দলটির রাজনীতিও নিষিদ্ধ হলো।
তবে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে সরকারের কাছে যুক্তি তুলে ধরে সরকারী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আপিল করতে পারবে। অবশ্য তারা আপিল করবে কিনা সে ব্যাপারে কোনও মন্তব্য না করে জামায়াতের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলের নেতা-কর্মীদের ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে প্রায় ২’শ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। আগের কয়েকটি মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজন করেছিলো। ওই বিচারে আদালতের রায়ে জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় সব নেতাকে ফাঁসি কিংবা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে কারফিউ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ১৪ দলীয় জোট নেতাদের সাথে বৈঠক করে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার আগ্রহের কথা জনান। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, সরকার নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। সেই অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি সম্পাদনের পর বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী সরকার জামায়াত-শিবিরের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কার্যালয় বন্ধ করতে পারবে। ব্যাংক ও অন্যান্য হিসাব অবরুদ্ধসহ সব সম্পদ জব্দ বা আটক করতে পারবে। জামায়াত-শিবিরের সদস্যদের দেশত্যাগে বাঁধা নিষেধ আরোপ করতে পারবে। দলীয় প্রচারপত্র, পোষ্টার, ব্যানার,  উল্লেখযোগ্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। জামায়াত-শিবিরের অথবা তাদের পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ, প্রচারণা. সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বাংলাদেশে ভয়াবহ সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সরকারের হিসাবে এসব সহিংস ঘটনায়  দেড়শ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সহিংস ঘটনাকে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেছে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করাকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালার নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন স্বাগত জানিয়েছে। তবে বিএনপি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পর কোনও কোনও  নাশকতার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের গ্রুপ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবিরা। এসব কর্মসূচি থেকে জাতিসংঘের মাধ্যমে হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবি জানানো হচ্ছে। যদিও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশই তদন্ত করবে। তবে জাতিসংঘ চাইলে বাংলাদেশের তদন্তে কারিগরি সহায়তা দিতে পারে।
গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটকে রাখা ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিবি কার্যালয়ে থাকাকালে তাদেরকে ভাত খাইয়ে তার দৃশ্য ফেসবুকে প্রচার করার প্রতিবাদে এই ছয় ছাত্র নেতা ৩২ ঘন্টা যাবত অনশন শুরু করলে সরকার তাদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। যদিও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগায় বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তার এই বক্তব্যের পরপরই প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়।
বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তো ১৯৭১ সাল থেকেই জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি। তিনি আরও বলেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘটনায় কেউ যদি নাশকতা চালায়, সেটা সরকার মোকাবিলা করবে। সেই সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। এর আগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের ফাইলে সই করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
প্রজ্ঞাপন জারির আগে দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে (গোপনে গিয়ে কার্যক্রম চালানো) চলে যাবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
প্রজ্ঞাপনের পর বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সদ্য নিষিদ্ধ দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে।
জামায়াত-শিবিরসহ এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১০টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। নিষিদ্ধ অন্য সংগঠনগুলো হলো-শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিজবুত তাহরীর, আনসারুল¬াহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল¬াহর দল এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।