বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২০ ১৪৩১   ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গণহত্যার দায় হাসিনা এড়াতে পারেন না

আজকাল রিপোর্ট -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৫৪ এএম, ৩ আগস্ট ২০২৪ শনিবার

বাংলাদেশ সংকট নিয়ে প্রবাসীরা যা বলছেন

 
বাংলাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলছে। সরকারি হিসেবেই ২ শত এর অধিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। যার অধিকাংশই সরকারি বাহিনীর হাতে। কোটা বিরোধী ইস্যু নিয়ে এই আন্দোলনের শুরু। কিন্তু এখন তা রূপ নিয়েছে সরকার বিরোধী আন্দোলনে। কারফিউ, মিলিটারি ও বিজিবি দিয়েও সরকার সামাল দিতে পারছে না। সারা দেশের মানুষ শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। প্রবাসেও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠিত বাংলাদেশিরা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মুখোমুখি হয়েছিল সাপ্তাহিক আজকাল। কি ভাবছেন এই প্রবাসীরা? তাদেও কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
এটর্নি মঈন চৌধুরী। কমিউনিটি একটিভিস্ট। কুইন্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এট লার্জ। আজকালকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা খুবই দুঃখজনক। র্নিবিচারে কাউকে গুলি করে হত্যা করার অধিকার কারো নেই। সরকারের প্রশ্রয়ে যা ঘটলো তা মেনে নেয়া যায় না। তবে আন্দোলনকারিরা সংহিসতায় না জড়ালেও পারতো। জনগণের সম্পদ নষ্ট করা সর্মথন যোগ্য নয়। কথা একটাই। বাংলাদেশ ভালো থাকুক। প্রবাসী হিসেবে এটাই প্রত্যাশা।  
ড্রামের অন্যতম সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মি কাজি ফৌজিয়া আজকালকে বলেন, সরকার প্রধান শেখ হাসিনা মানবতা লংঘনের চরমে পৌঁছে গেছেন। নিরীহ ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করে হত্যার অপরাধে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার  আর্ন্তজাতিক ট্রাইবুনালে বিচার হওয়া উচিত।  শতশত মানুষ হত্যার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। আমরা বাংলাদেশে আন্দোলনকারি ক্ষতিগ্রস্থ ছাত্রছাত্রীদের সহায়তার জন্য ফান্ড পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি।
আনিসুর রহমান ২০১৭ সালে আমেরিকায় এসেছেন। রাজনীতি সচেতন আনিস আজকালকে বলেন, শেখ হাসিনা সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের চেয়েও জঘন্য। তাকে জনতার আদালতে একদিন আসতেই হবে। রাজপথের উত্তাপ তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলার ১৮ কোটি মানুষ তার পতনের দৃশ্য দেখার অপেক্ষা করছেন।
আলমগীর সরকার জ্যামাইকায় বসবাস করেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। তিনি বাংলাদেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে সাপ্তাহিক আজকালকে বলেন, ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনটি সরকার নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিতেই হয়েছে। কিশোর এবং তরুণদের গণহারে হত্যার পর এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু, মানবাধিকার লংঘন ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিনা ভোটের সরকার শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত ন্যায্য দাবিকে চরম অবহেলার সঙ্গে ডিল করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেদিন বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ পাঠিয়েছি তারাই ঠিক করে দেবে।’ তারপর  হেলমেটধারী ছাত্রলীগের হাতে শতশত শিক্ষার্থী বেদম প্রহারের শিকার হয়েছেন। শতশত তরুণ  মেধাবী শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই গণহত্যার দ্রুত বিচার দাবী করছি।
নাফিসা সৈয়দা নিউইয়র্কের একজন শিক্ষার্থী। তিনি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে টাইমস স্কয়ারে পরপর দু’বার বিক্ষোভ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে এখন আলোচনায়। ‘সাপ্তাহিক আজকাল’কে তিনি তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমরা যখন দেখলাম বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের প্রতিবাদ করায় অসংখ্য শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষকে গণহারে হত্যা করা হচ্ছে তখন টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভ প্রতিবাদ করার পরিকল্পনা করি। এত হাজার হাজার মানুষের ভিড় হবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি। তবে দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষার্থীদের হত্যার মতো ভয়াবহ অবস্থা সরকার কেন করলো আমরা তার জবাব চাই। সরকারের কোন ক্ষমা প্রার্থনা কি তাদের মূল্যবান জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে? সাধারণ শিক্ষার্থীরা কথা বলার জন্য এমন নির্মম হত্যার শিকার কেন হবেন তাই জানতে চাই আমরা।
শিক্ষা জীবন শেষ করে আইটির একজন দক্ষকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন মীর শওকত। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্য বর্বর হত্যাকান্ড ঘটেছে।  শিক্ষার্থীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সে সকল ভিডিওগুলো দেখলে রাতে কারো ঘুম হবে না। পুুলিশের বর্বরতা দেখে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। নিহত হয়েছে শতশত। আহত হয়েছে আরও বেশি।  কেউ কেউ গুলিতে অন্ধত্ব বরণ করেছে। ২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক জঘন্য নজির হিসেবে থাকলো। এমন ঘটনার জন্য আমরা প্রবাসীরা কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।
পলাশ রহমান বাংলাদেশে গণহারে শিক্ষার্থী হত্যায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাপ্তাহিক আজকালের কাছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের  দোসররা বলছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আসলে তা নয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে দেশ থেকে জানা গেছে। পুলিশ সেই তালিকা ধরে এলাকা ভিত্তিক রাতের বেলায় ব্লক রেইড দিচ্ছে। বাড়ি থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অমরা প্রবাসীরা এমন নির্মম গণহত্যাকান্ডে চরমভাবে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা এই গত্যহত্যার তদন্ত  ও বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
সাইফুল ইসলাম পেশায় শিক্ষক। বাস করেন ব্রুকলিনে। তিনি আজকালকে বলেন,
দেশে যে কি বৈষম্য চলছে তা আন্দোলনের আগে অনেকে জানতোই না। কর্তৃতবাদী সরকার ছাত্রদের ন্যায্য দাবির প্রতি কর্ণপাতই না করে তার পেটুয়া বাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগের পাশাপাশি জনগণের টাকায় পালিত সম্মিলতি বাহিনী দিয়ে ছাত্রদের বুকে নির্বিচার গুলি করল। কোন সভ্য দেশে এভাবে মানুষের বুকে গুলি করতে পারে না।  কোন স্বাধীন দেশে এটা হতে পারে না। এমনকি হত্যাযজ্ঞের তথ্য চাপা দিতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, মিডিয়াও নিয়ন্ত্রণে নেয়। যে সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি রক্ষা কওে, তারাই কারফিউর সময়ও নিজের দেশে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সংবাদ মাধ্যমই বলছে প্রায় আড়াইশ জনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ হওয়ার আশংকাও রয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। দুই লাখের বেশি মানুষের নামে অজ্ঞাতনামা মামলা করা হয়েছে। তবে সীমাহীন অত্যাচার, নিপিড়ন, হত্যাযজ্ঞের পরও ছাত্র-জনতা আন্দোলনে অবিচল। তাদের কাতারে পেশাজীবি ও সাধারণ মানুষও সামিল হয়েছে। ইতিহাস বলে, জালিম যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তা শেষ আছে, অন্যায়কারীরও পতন আছে। ছাত্র জনতার এই অকুতোভয় প্রতিরোধ একদিন সকল অন্যায়ের বিচারের পথ সুগম করবে ইনশাআল্লাহ।

মুরাদ হোসাইন পেশায় সাংবাদিক। নিউইয়র্কের জামাইকায় তার বাস। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মসনদে থাকার লিপ্সায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের উপর গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাহিনী দিয়ে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বুলেটই সাধারণ মানুষের বুক লক্ষ্য করে মারা হচ্ছে। যদিও সহিংসতার জন্য সরকার জামায়াত-বিএনপি-শিক্ষার্থীদের দায়ী করছে। এর দুটি দিন আছে। এক, গণহত্যাকে বৈধতা দেয়া; দুই, জনগণের সিমপ্যাথি অর্জন। দ্বিতীয় লক্ষ্যটাকে আমি নিষ্পাপ বলব। এটা ডুবন্ত তরী রক্ষার চেষ্টা। গলাবাজির মাধ্যমে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা, যাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়, তবে মানুষের দায়িত্ব বিভ্রান্ত না হওয়া। নানা কৌশলে সরকার এই আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করলেও মানুষ স্বৈরাচারী এই সরকারের পতনে সোচ্চার। হয়তো খুব শিগগিরই রোমানিয়া বা শ্রীলংকার মত আরেকটি গণঅভ্যুত্থান বিশ্ববাসী দেখতে পাবেন। এর মাধ্যমে নতুন করে আরেকটি স্বাধীনতা অর্জন করবে বাংলাদেশ বলে আমি মনে করি।

রাজিয়া মলি -চাকুরীজীবি।  প্রবাসী এই বাংলাদেশি ভার্জিনিয়ায় বসবাস করেন। তিনি আজকালকে বলেন, বাংলাদেশে ছাত্রদের সঙ্গে যা হচ্ছে, তা আর নিতে পারছি না। ছোট ছোট বাচ্চাদের হত্যা করা হচ্ছে। রাস্তায়, বারান্দায়, ঘরে বাবা-মার কোলে কোথাও কেউ নিরাপদ না, বুলেট এসে যে কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। ১৯৫২ সালে, ১৯৭১ সালের দেশের যে অবস্থা ছিল, এবারের নির্মমতা যেন তাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরাতো না হয় পর ছিল তারা মেরেছে। আমরা নিজেদের দেশের লোকের হাতেই মার খাচ্ছি। তাই প্রশ্ন জাগে তারা আমাদের নিজেদের লোক তো? সাধারণ একটা বিষয় যেখানে এক কথায় সমাধান করা যেত, সেখানে ক্ষমতার দম্ভে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণ নিল। কারণ যাদের হাতে ছাত্রসহ নিরপরাধীর রক্ত লেগেছে তারা আর যাই হোক মানুষ না। কিন্তু আমরা এ ছাত্র-জনতা খুনের বিচার। সরকার খুনি তারা কিভাবে খুনের বিচার করবে। তাই এখন একটাই বিষয় উঠে আসছে এ সরকারের পতন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।

অপূর্ব বাবু-চাকরীজীবি।  ব্রংকসের বাসিন্দা। তিনি আজকালকে বলেন, যে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে ছাত্ররা আন্দোলন করতেই পারে, জনগন আন্দোলন করতেই পারে। তা হিংষ ভাবে মোকাবেলা করা উচিত না। দাবি ন্যায্য হলে সরকার মেনে নেবে, না হলে আলোচনা চলবে। ছাত্রদের আন্দোলনও ন্যায্য ছিল বলেও সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই সরকার পুলিশসহ সব বাহিনী দিয়ে তাযে ভাবে দমন করেছে, যেভাবে মানুষ খুন হয়েছে তা মেনে নেওয়া যা না। তবে আন্দোলনের সময় যে ভাঙচুর হয়েছে তাও কাম্য নয়। কারণ, মানুষ ও বিভিন্ন স্থাপনা সবই এ দেশের। ক্ষতি দেশেরই। যা ক্ষতি হয়েছে তাতো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে সামনে যেন আর কোন সংঘাত না হয়, প্রাণ না যায়, ধ্বংস না দেখতে হয়, এটাই চাই।