শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৪ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শপথ নিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:২৯ এএম, ৯ আগস্ট ২০২৪ শুক্রবার

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কার্যত তিন দিন দেশ সরকারশূন্য ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ জন শপথ নিয়েছেন।

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর গত রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যে-ই ছড়াবে, বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে।’

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নতুন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হয়েছেন, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম। উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করার কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিলাম, যে প্রতিশ্রুতির জন্য শত শত ভাইবোন হতাহত হয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতেই আমরা সরকারে এসেছি। সেই প্রতিশ্রুতিগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে পূরণ করার জন্য সচেষ্ট থাকব।’

এই সরকারে মোট উপদেষ্টা ১৬ জন। সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা, চিকিৎসক বিধান রঞ্জন রায় ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক-ই-আজম ঢাকার বাইরে থাকায় শপথ নিতে পারেননি। উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়া অন্য ১১ জন হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নির্বাহী পরিচালক আদিলুর রহমান খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, নারী অধিকারকর্মী ফরিদা আখতার, ইসলামি চিন্তাবিদ আ ফ ম খালিদ হাসান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম ও নির্বাচনব্যবস্থা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শারমিন মুরশিদ।

 উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সরকারের অগ্রাধিকার নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, গত কয়েক দিন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ হয়েছে। কোনো কোনো দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় দখলের সংস্কৃতিতে নেমেছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

উপদেষ্টারা শপথ নিলেও কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন, তা ঘোষণা করা হয়নি। তবে গত কয়েকটি সরকারের মন্ত্রিসভার আকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন গুণ বা এর কাছাকাছি ছিল। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কাঁধে একাধিক মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্ব পড়তে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘যে অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি, আমরা যেন সেই শক্তির মতো হয়ে না যাই। তাহলে ছাত্র-জনতা যে অভাবনীয় একটা সুযোগ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে, সেটার অর্জন ও ও মাহাত্ম্য ম্লান হয়ে যাবে।’ আরেক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ মন্তব্য করেন, একটা বিধ্বস্ত অবস্থায় এ সরকার গঠিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে এগোনোর জন্য সরকারের সময় প্রয়োজন।

গত সোমবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে মাত্র সাত মাসের মাথায় তাঁর টানা চতুর্থ মেয়াদের সরকারের অবসান ঘটে। পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংসদ ভেঙে দেন। এতে দেশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিশূন্য হয়ে পড়ে। সরকার না থাকা এবং সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরই দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি ওঠে। কারণ, গত তিন দিনে দেশে বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা ঘটনা ঘটতে থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রথম প্রস্তাব করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। তাঁদের ৩৬ দিনের টানা আন্দোলন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক দফা দাবি ঘোষণার পরদিন সোমবারই পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এরপর মঙ্গলবার ভোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়।

এর আগে সোমবার বিকেলে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও অন্য দুই বাহিনীর প্রধান সেনানিবাসে বৈঠক করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আরেকবার বৈঠক হয়। এতে রাজনীতিক, ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও তিন বাহিনীর প্রধানেরা অংশ নেন। তবে কোনো বৈঠকেই আওয়ামী লীগ বা তাদের সমমনা দলের কোনো প্রতিনিধিকে ডাকা হয়নি। এসব বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোও ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে সম্মতি দেয়।

অবশ্য এ সময়টায় ড. ইউনূস প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে তাঁর সম্মতি জানান। গতকাল বেলা ২টা ১০ মিনিটে ঢাকায় আসেন ড. ইউনূস।

উপদেষ্টা নির্বাচনে তৎপরতা

বিমানবন্দরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধানেরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শারমিন মুরশিদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন প্রমুখ।

বিমানবন্দরেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। সেখানে নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কারা থাকছেন—এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠকে অংশ নেওয়া সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে সম্ভাব্য উপদেষ্টাদের নামের তালিকা দেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শের সময়ও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেওয়া তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকের সারমর্ম প্যারিসে থাকা অবস্থায় ড. ইউনূসকে অবহিত করা হয় বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে ড. ইউনূস উপদেষ্টাদের একটা সম্ভাব্য তালিকা প্রস্তুত করেই দেশে ফেরেন। বিমানবন্দরের বৈঠকে এই তালিকার চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।

নতুন সরকারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রয়েছেন। আছেন চারজন নারীও। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছেন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা। সরকারে ব্যবসায়ী কিংবা আমলার সংখ্যা তুলনামূলক কম। অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোতে একাধিক ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতিনিধি ছিলেন।

উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এ জন্য নতুন সরকারে তাঁদের থাকার বিষয়ে আগে থেকেই আলোচনা ছিল। অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোতে পুলিশের প্রতিনিধি ছিলেন। এবার সরকারে অবসরপ্রাপ্ত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা নেই।

রাষ্ট্র সংস্কার, বৈষম্য দূর করা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হবে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে এককথায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার চাই।’

নতুন সরকারের সামনে দেশের ব্যাংক খাতের দুরবস্থা দূর করা এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এই চিন্তা থেকেই সরকারে স্থান পেয়েছেন বলে আলোচনা আছে। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে দক্ষতা থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন সরকারে স্থান পেয়েছেন। আদিলুর রহমান খান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারাবরণসহ নানাভাবে নিগৃহীত হন।

শপথ অনুষ্ঠান

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন রাত সোয়া নয়টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ পড়ান। এরপর ১৩ জন উপদেষ্টাকে শপথ পাঠ করানো হয়। শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের জোট ১৪ দলের কাউকে দেখা যায়নি।

শপথ অনুষ্ঠানে দরবার হলে প্রথম সারির মাঝখানে বসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বাঁ থেকে এরপর বসেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং এরপর অন্য উপদেষ্টারা।

প্রধান উপদেষ্টার ডান দিকে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান হাসান মাহমুদ খাঁন। এরপর বসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ।

দ্বিতীয় সারিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বসেন। আরও ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া।

জাতীয় সংসদের স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে সাধারণত উপস্থিত থাকেন। তবে এবার তাঁদের দেখা যায়নি।