শূন্য হাতে এসে মানুষ শূন্য হাতেই ফেরে
ধর্ম ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৭:০৫ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার
বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে মানুষ সবকিছুই বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে।
কিন্তু যুক্তিতর্ক সীমাবদ্ধ জ্ঞানের বাইরেও পৃথিবীতে অহরহ অনেক কিছুই ঘটছে যেখানে পৌঁছতে বিজ্ঞান চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
একদিন মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে বিশ্বজগৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কতটুকু আবিষ্কার করেছে। কিয়ামত, হাশর, পরকাল, বেহেশত, দোজখ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করতে পারে, আবার কেউ কেউ তা অস্বীকারও করতে পারে।
তবে পরকালের প্রথম ধাপ যে মৃত্যু এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। অথবা মৃত্যুকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগও নেই। কারণ এ পর্যন্ত ফেরাউন, সাদ্দাদসহ মহাপরাক্রমশালী কোনো রাজা বাদশা, সেনাপতি ও মহাবীর তাদের ক্ষমতাও শক্তিমত্তা অথবা আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, নিউটনের মতো কোনো বৈজ্ঞানিক তাদের গবেষণা ও জ্ঞানের বলে মৃত্যুর কঠোর হাত থেকে মুক্তি পায়নি।
এমনকি দুনিয়ার শেষ দিনটি পর্যন্ত ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ইচ্ছায় মত্যুকে বরণ করতেই হবে। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, তোমরা যেখানেই অবস্থান কর না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই যদিও তোমরা সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। (সূরা নিসা; আয়াত ৭৮)।
তবে এখানে একটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ যে হাজার হাজার কোটি টাকার ধনসম্পদ, নয়নাভিরাম দালানকোঠা ও অট্টালিকা নির্মাণ করেছে এগুলোর কী হবে? এগুলোর কতটুকু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগের ঘটনা। পৃথিবী দেখেছিল এক বিশাল প্রতাপশালী রাজাকে। তিনি প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে তার জন্ম। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন তৃতীয় আলেকজান্ডার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। বলিষ্ঠ চেহারা আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সব রাজার থেকে স্বতন্ত্র।
সিংহের মতোই ছিল তার বিক্রম। মাথায় সব সময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্দু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডারকে, বলা হতো অর্ধেক পৃথিবীর রাজা। কারণ গ্রিসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন ছাপিয়ে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন তিনি।
কারণ লিওনিদাসের মতো একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীরবিদ্যায় প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। আর মাত্র তেরো বছর বয়সে শিক্ষা লাভ করেছিলেন মহান গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের পাঠশালায়।
মূলত এ সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচণ্ড শরীরিক দৃঢ়তা ও মেধার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের মে মাস। বিশ্ব কাঁপিয়ে দেয়া এই বীরের বয়স তখন ৩৩। সিংহাসনে আরোহণের পর এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন চেনা পৃথিবীর অনেকটা জয় করতে।
আলেকজান্ডারের স্বপ্ন ছিল তার বিশাল সাম্রাজ্যের আরও বহুদূর বিস্তৃতি ঘটাবেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন কখনই বাস্তবে রূপ নিল না। সেনাবাহিনীর বাধার মুখে কয়েক বছরের সামরিক অভিযান শেষ করে আলেকজান্ডার ফিরে এলেন বাগদাদে।
২৯ জুন তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণে এক ভোজসভায় যোগ দিলেন। দিনব্যাপী এ আয়োজনে আলেজান্ডার প্রচুর মদ পান করেন। এক সময় অস্বস্তি বোধ করেন। এ কথা বলে তিনি ঘুমোতে চলে যান।
এ সময় প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ওঠে তার। দ্রুত তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে গেলেন যে, বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। বিশ্ববিজয়ী এই বীর দশ দিন পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড করে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিলেন তার জেনারেলরা। মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার গড়া বিশাল সাম্রাজ্য।
মৃত্যুশয্যায় তার ইচ্ছা : মৃত্যুশয্যায় সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা তিনটা ইচ্ছা পূরণ করবে এতে যেন ব্যত্যয় না ঘটে। প্রথম ইচ্ছা শুধু চিকিৎসকরা আমার কপিন বহন করবে। দ্বিতীয় ইচ্ছা যে পথ দিয়ে আমার কফিন কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে সেই পথে কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা-রুপা, মণিমুক্তা ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি ছড়িয়ে দিতে হবে।
শেষ ইচ্ছা কফিন বহনের সময় আমার দুহাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। তার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীর আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত ইচ্ছা শুনে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ।
তখন আলেকজান্ডারের একজন প্রিয় সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বললেন, হে মহামান্য আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করা হবে। কিন্তু আপনি এই বিচিত্র ইচ্ছা কেন করলেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার বললেন, আমি দুনিয়াবাসীর সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে যাতে লোকেরা বুঝতে পারে যে, চিকিৎসকরা আসলে মানুষকে আরোগ্য করতে পারে না। তারা ক্ষমাতাহীন আর মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম।
গোরস্তানের পথে সোনাদানা, মণিমুক্তা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বুঝাতে যে, এগুলোর একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো অর্জনের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না।
মানুষ এটা উপলব্ধি করুক যে ধনসম্পদ অর্জনের জন্য শক্তি ব্যয় করা সময়ের অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে হাত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছি দুনিয়ার মানুষকে এটা জানাতে যে, খালি ও শূন্য হাতে আমি এ পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার শূন্য হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।
শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আল্লাহ পাক বলেছেন, বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না (সূরা আলে-ইমরান; আয়াত ৭)। অন্য আয়াতে বলেছেন, নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। (সূরা আল ইমরান: আয়াত ১৩)। হে আল্লাহ বিশ্ববাসীর অন্তর খুলে দিন। তারা যেন বোধশক্তি সম্পন্ন হয়।