চেয়েছিল দুনিয়া পেয়ে গেল জান্নাত
ধর্ম ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৭:৩০ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার
তাকালে চোখ ফেরে না। যেমনি দেখতে। রূপ যেন টসটস করে। দাসের ছেলে। এত সুন্দর। যেন মাবুদের আপন হাতে গড়া। যখন সে হাঁটে। বসরানগরী ঝলমলিয়ে ওঠে।
নগরীতে ছিল এক সাধনা ঘর। একদিন ঢু মারে ওখানে। ইচ্ছা জাগে এখানের প্রধান হতে। সাধনায় বছর কাটল তার। কী রাত। কী দিন। অন্য সাধকরা মালেক দিনারকে মোরাকাবায় পেত। অবাক হতো ভারি। এত সাধনা মানুষ কীভাবে পারে। ভেবে পেত না।
এক গহিন রাতে বেরোল সে। ‘তোমার কী এখনও ফেরার সময় হয়নি মালেক?’ গায়েবি বাণী শুনল। কেঁপে উঠল তার ভেতর জগৎ। তক্ষুণি ছুটে গেলেন বসরার বড় মসজিদে। লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইলেন। হে মাবুদ। সাধনা ঘরের প্রধান হওয়ার বন্দেগি করেছি। তোমাকে পাওয়ার সাধনা করিনি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। হায় আমার কী বদনসিব।
কী লজ্জার কথা। সাধনা ছিল প্রেমহীন ইচ্ছার গোলামি। আহাজারিতে কাটল রাত। ভোরের আজানে মুসল্লিরা এলেন জামাতে। নামাজ শেষে সভায় জড়ো হলেন তারা। নগরীর এই মসজিদে প্রধান ইমাম প্রয়োজন।
আলোচনা করতে করতে সবাই মসজিদের কোনায় এগোলেন। ইবাদতে মগ্ন ছিলেন মালেক দিনার। বন্দেগি শেষে নামাজিরা তার চারপাশে বসল। হে মালেক দিনার। তোমার চেয়ে যোগ্য কাউকে আর দেখছি না। তুমি এই মসজিদের প্রধান হও। অনুরোধ জানাল কাতর কণ্ঠে।
প্রস্তাব শুনে সিজদা দিলেন মালেক দিনার। কেঁদে কেঁদে বললেন হে মাবুদ, প্রধান পদ পেতে বছর কাটালাম। মনে মনে কত লোককে দেখলাম ইবাদত-বন্দেগিতে। কেউ ফিরেও দেখেনি আমাকে। মাত্র এক রাত সমর্পিত হয়েছি তোমার প্রতি।
এতেই তুমি মানুষের মাধ্যমে মসজিদের প্রধান হতে আবদার জানালে। হে মাবুদ আমার। তোমার দয়ার গুণগানের শপথ করছি। আমার দুনিয়ার কোনো কিছুর আর আকাক্সক্ষা নেই। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন মালেক দিনার। গভীর সাধনায় মাবুদকে জয় করার নিয়তে মোরাকাবায় বসলেন নির্জনে।
মালেকের প্রতিবেশী ছিলেন ইহুদি। বদখেয়ালি এ লোকের টয়লেট ছিল মালেকের বাড়ি ঢোকার পথে। মালেকের উঠান ভেসে যেত ময়লায়। কোদাল বালতি প্রস্তুত থাকত। প্রতি সকালে মালেক সেসব পরিষ্কার করে ফেলতেন। গোপন অত্যাচার তিনি গোপনই রাখতেন।
বদখেয়ালি একদিন জিজ্ঞেস করল। আচ্ছা আমার টয়লেটে তোমার কষ্ট হয়? হ্যাঁ হয়, বলল মালেক। আচ্ছা তুমি অভিযোগ করছ না কেন আমার বিরুদ্ধে? মাবুদের ইচ্ছায়। বলল মালেক। মাবুদ বলেছেন রাগকে বস কর।
আমি প্রতিদিন রাগ বস করে ওগুলো পরিষ্কার করে ফেলি। বদখেয়ালি ইহুদি অবাক হয়ে বলল, হায় কী উত্তম ধর্মের মানুষ তুমি। ঈশ্বরকে ভালোবেসে শত্রুর অত্যাচার সহ্য কর। অভিযোগ কর না। পেরেশান হইও না। এত ধৈর্য তোমার। বলেই তিনি কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
মালেক দিনার একটি করে শুকনো রুটি খেতেন রাতে। এভাবে কাটল বহু বছর। এক অসুখে মন তার দিওয়ানা হল। মাংস মাংস জপ করল। মনের অত্যাচারে একদিন মাংসের দোকানে গেলেন। এক টুকরো ছাগলের মাংস কিনে চাদরে ঢেকে বাড়ি এলেন।
নামাজের সুরতে বসে তিনবার ঘ্রাণ নিলেন মাংসের। এক ভিক্ষুককে দান করে বললেন। হে আত্মা বহুভোগ করেছ আজ। আর নয়। দুর্বল মন আমার শোন। কোনো দুষমনি নেই তোমার সঙ্গে। আমি তোমার শত্রু নই। আর কদিন সবুর কর। দুঃখের দিন একদিন ফুরাবে। তখন এমন ফল ভোগ করবে যা চিরকাল ফুরাবে না।
চল্লিশ বছরে একদিনও খুরমা খেয়ে দেখেননি মালেক। প্রতি মৌসুমে তিনি বলতেন, হে বসরাবাসী দেখ প্রতিদিন খুরমা খেয়ে তোমাদের পেটের যেমন উন্নতি হয়নি, আমার পেটেরও কোনো ক্ষতি হয়নি।
এ ঘটনার পর হঠাৎ খুরমা খুরমা জপতে লাগল মন। তিনিও মনকে শাসাতে লাগলেন। হে মন, তোর এই ইচ্ছা কখনও পূরণ করব না। এরপর একদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন কেউ তাকে বলছে আত্মাকে কষ্ট দিও না আর। ওকে খুরমা খাওয়াও।
এই স্বপ্ন দেখে আত্মা আবার খুরমা খুরমা জপতে লাগল। আত্মাকে এক শর্ত দিল সে। এক সপ্তাহজুড়ে কিছু না খেয়ে রোজা রাখতে হবে। তখন তোমার ইচ্ছা পূরণ করব হে মন। শর্ত মেনে মন রোজার ব্রত পালন করল।
মালেক কথামতো কিছু খুরমা কিনলেন। এক মসজিদে ঢুকলেন খুরমা খেতে। এক শিশু ঘটনা দেখে আব্বাকে ডাকতে লাগল। আব্বা এসে দেখে যাও। এক ইহুদি আমাদের মসজিদে বসে খুরমা খেতে চাচ্ছে। ছেলের হাঁক ডাকে বাবা মুগুর হাতে ছুটে এলেন।
ইহুদির এত সাহস আমাদের মসজিদে ঢুকছে। ছুটে এসে ভয়ে আতকে উঠলেন বাবা। মুগুর ফেলে লুটিয়ে পড়লেন মালেক দিনারের পায়ে। হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন। আমার ছেলে চিনতে পারেনি। এলাকায় ইহুদি ছাড়া সবাই দিনে রোজা ব্রত পালন করে।
কথা শুনে ভারি দুঃখ পেলেন মালেক। কেঁদে কেঁদে সিজদায় পড়ে বললেন হে মাবুদ খুরমা না খেতেই ইহুদি তকমা দিলেন। আর যদি খেতাম কাফেরের কাতারে ফেলতেন নিশ্চয়ই। আপনার পবিত্রতার শপথ করে বলছি।
এ জীবনে কখনও খুরমা খাব না। শেষ জীবনে মক্কা গিয়েছিলেন তিনি। লাব্বাইক, অর্থাৎ আমি হাজির। হাজীদের সম্মিলিত ধ্বনি শুনে তিনি জ্ঞান হারালেন। হুশ এলো অনেকক্ষণ পর। লোকেরা এর কারণ জানতে চাইল।
হজরত আপনি বেহুশ হলেন কেন। আমি হাজির বলার পর মাবুদ যদি বলেন তুমি হাজির নও। এ ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম।
সাধক হোসাইন বসরির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাগরেদ ছিলেন তিনি। দামেস্কে জন্মেছিলেন। শেষ বয়স এ নগরেই কেটেছে। তাই মানুষ তাকে মালেক দিনার দামেস্কি নামে চিনত।
তার কিছু অমর কথা : * হায়! কত অভাগা আমি। মাবুদের দান ভোগ করে শয়তানের গোলামি করি। * মোহময়ী সংসারে ডুবে যেও না। জ্ঞানীদের হৃদয়ে সে প্রেম চুমু হয়ে জেঁকে বসে। * মাবুদের জিকিরে হৃদয় ভিজাও। বেশি ধর্মালাপের বাচালতায় হৃদয় খোঁড়া হয়ে যায়। * মাবুদ তোমার সেবা করছেন। তার প্রতি সমর্পিত থাক তুমি। এতেই মুক্তি মিলবে। * হায় অভাগা মানুষ। জগৎজুড়ে মাবুদই সঙ্গীত করছেন। তোমরা কেউ সঙ্গীতের সঙ্গে নাচলে না। * সাধনার সম্পদে ভরপুর সাধকের হৃদয়। পরকালের পুরস্কার খুঁজে নেবে তাকে। * যে জ্ঞানী সংসার মোহে বন্দি তার হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় মাবুদ স্মরণ।