মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ছাগলের মাথা পাল্টে দিল জীবন

ধর্ম ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৭:৩৩ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার

ধু-ধু রোদে পুড়ছে বালি। সূর্য হুল ফোটাচ্ছে যেন। ছেলেরা ছোটাছুটি খেলছে। হঠাৎ থেমে গেল সবাই। গায়ে ইয়া বড় জুব্বা। ঢাউস পাগড়ি মাথায়।

এ পথেই আসছেন তিনি। চল পালাই। সুদখোর আসছে। ওকে দেখলে অমঙ্গল হবে। বলেই দৌড়াল।

সুদখোরের নিন্দা শুনে ব্যথা পেল হাবিব। ফেটে যেতে চাইল হৃদয়। ভারি মন খারাপ হল তার। চিন্তিত মনে এক পাওনাদারের বাড়ি গেলেন। আজ কিস্তি পরিশোধের তারিখ। বাড়িওয়ালা কাজে গেছেন।

বউ ঘর থেকে বললেন, সুদ দেয়ার মতো কিছু নেই। আছে একটা ছাগলের মাথা। চাইলে তাই সুদের বদলে দিতে পারি। মহাজন চান সময়মতো কিস্তি। খুশি মনে তিনি ছাগলমুণ্ড হাতেই ঘরে এলেন। বেশ মজা করে খাওয়া যাবে। বউকে রাঁধতে বলে গোসলে গেলেন। সেদিন মসলাপাতিও কিনেছিলেন কিস্তির সুদের টাকায়।

মৌ মৌ খুশবু ছড়িয়ে রান্না হচ্ছে ছাগলমুণ্ড। তর সইছে না আর। দস্তরখানা পেতে অপেক্ষা করছে খাওয়ার। এক ভিখারি এলো হঠাৎ। খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার দেবেন। আবদার এলো বাইরে থেকে।

খিদে পেয়ে চো চো করছিল হাবিবের পেট। ভিখারিকে ধমকালেন। এখানে কিছু মিলবে না। চলে যাও বলছি। যে খাবার আছে, তোমাকে দিলে আমরা নিন্দিত হব। খিদে পেটে বিদায় নিল ভিখারি।

এ সময় রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত ছুটে এলো বউ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ওগো দেখে যাও। মাংসের হাঁড়ি রক্তে ভরে গেছে। হায়! কী দুর্ভাগ্য আমাদের। হাঁড়িভর্তি ফুটন্ত রক্ত দেখে ভেঙে পড়লেন হাবিব। সুদের কারবারেই এমন হয়েছে ভাবলেন।

আজ থেকে আর ঋণ দিয়ে সুদ নেবেন না। ছুটে গেলেন হোসাইন দরবেশের খানকায়। তার উপদেশে মন প্রশান্ত হল। পরিবর্তন এলো জীবনে। অনুতপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। এক দেনাদার তাকে দেখে অন্যপথ খুঁজল ভয়ে।

ও ভাই, পালিও না তুমি। হাবিব এগোল তার দিকে। আজ তোমার পালানোর প্রয়োজন দেখছি না। বরং আজ আমারই পালান উচিত। বলেই তিনি ঘুর পথে বাড়ি যেতে লাগলেন। ছোটাছুটি খেলার সেই ছেলেরা বলল, পবিত্র আত্মার হাবিব আসছেন।

আমাদের পাপ শরীর যেন তাকে কলুষিত না করে। চলো দূরে সরে যাই। মাবুদের কাছে আমরা দোষী হব তার সঙ্গে বেয়াদবি হলে। বিস্ময়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল হাবিব। হে আমার মাবুদ তোমার সঙ্গে ভাব হয়েছে মাত্র একদিন। এতেই তোমার ফেরেশতাদের মনে প্রভাব ঢেলে দিয়েছ? এরপর হাবিব ঋণে বন্ধকী সব কিছু মালিকদের বুজিয়ে দিয়ে মুক্ত হলেন।

আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে কিছু দিন। এক ভিখারি এলো। হাবিব গায়ের জামা দিলেন ভিখারিকে। অন্য এক ভিখারি এসে আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু চাইল। তাকে দিলেন বউয়ের পরনের কাপড়।

ঘরের সব বিলিয়ে সুখী হলেন হাবিব। ফোরাতের নির্জন তীরে গড়লেন এক সাধনার ঘর। দিবস কাটান হোসাইন বসরির কাছে তালিম নিয়ে। রাত যাপন করেন একান্তে সিজদায়। বেশ কদিন খিদে সইলেন ঘরের বউ। একদিন বললেন, কিছু আনো রান্না করব। কাজ করতে যাচ্ছি।

কিছু হলেই পাঠিয়ে দেব। বলেই হাবিব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়েন। দিন শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামে। হাবিব ঘরে ফেরেন। বউ খাবারের কথা বলে। উত্তরে হাবিব বলে যার কাজ করি উদার খুব তিনি।

তার কাছে কিছু চাইতে বড় লজ্জা করে আমার। যথাসময় সব বুঝিয়ে দেবেন তিনি। প্রতি ১০ দিনে পারিশ্রমিক দান করেন। এসব বলে ভোরের আলোয় ফোরাতের সাধনা ঘরে চলে যান।

দিনভর ইবাদত-বন্দেগি করে ঘরে ফেরেন সূর্যি ডুবলে। ৯ দিন পার হল এভাবে। ১০ম দিনও কাটল। আজ কী নিয়ে ঘরে ফিরব? এ চিন্তায়। সন্ধ্যায় অনেক সংকোচে ঘরে ফিরতে লাগলেন হাবিব। ভাবলেন সন্ধ্যার আঁধার আমাকে ঢেকে দিলে কত না ভালো হতো। ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাহারি খাবারের সুবাস আসছে তারই ঘর থেকে। ধীর পায়ে এগোলেন ঘরের দিকে।

হাবিবকে দেখেই ছুটে এলেন বউ। খুশি ছড়িয়ে বললেন, তুমি যার কাজ করছ বড় ভালো খুবই দয়াবান লোক তিনি। এক ভার মধু, ভারভর্তি ঘি, এক ভার ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্য দিয়ে এক যুবককে পাঠিয়েছেন তিনি।

সঙ্গে দিয়েছেন এক থলি তামার মুদ্রা। ওই যুবকটিকে তোমার মনিব বলতে বলেছেন, যত বেশি মনিবের সেবা করবে তত বেশি পারিশ্রমিক পাবে হাবিব। সব শুনে হাবিব বললেন মনে মনে, হে আমার মাবুদ! ১০ দিন মাত্র তোমাকে ডাকলাম, এতেই তুমি এত দিলে।

হায়! জীবন ভর যদি বন্দেগি করতাম তাহলে তুমি কী জানি দিতে! বউকে ধরে শুকরিয়ার কান্না কাঁদলেন। তারপর সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। এভাবেই মাবুদের সঙ্গে ভাব হল হাবিবের।

একদিন হল কী। মাগরিব ওয়াক্তে হোসাইন বসরি এলেন। হাবিব আজমি নামাজে ছিলেন। তিনিও তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইমামের কেরাতে উচ্চারণ শুদ্ধ হচ্ছে না ভেবে তিনি একাকী নামাজ আদায় করলেন।

সে রাতে স্বপ্নে তিনি মাবুদকে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, হে মাবুদ তুমি কিসে খুশি? মাবুদ বললেন, আমি তোমার প্রতি খুশি ছিলাম। সে খুশি ধরে রাখতে পারনি তুমি। হোসাইন বসরি কান্না কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মাবুদ গো কী অপরাধ আমি করেছি।

মাবুদ বললেন, তুমি হাবিব আজমির ইমামতি মেনে নাওনি। তুমি তার উচ্চারণে শুদ্ধতা খুঁজেছ। তার বিশুদ্ধ হৃদয়ের সহি নিয়ত দেখতে পাওনি। শুদ্ধ তেলাওয়াতের চেয়ে পরিশুদ্ধ হৃদয় আমি পছন্দ করি।

প্রেমভাবে মাঝে মাঝেই কাঁদতেন হাবিব আজমি। কেঁদে কেঁদে দেওয়ানা হয়ে বলতেন। হে মাবুদ, যে হৃদয়ে তোমার প্রেম নেই, সে হৃদয় প্রেমশূন্য করে দাও। কোরআন পাঠ হলে হাবিব কেঁদে কেঁদে বেহুশ হয়ে যেতেন।

তার কান্না দেখে মানুষ বলত, ভিন্নভাষী তুমি। কোরআন তো বোঝ না। এত কান্না তোমার কীভাবে আসে। কেঁদে কেঁদেই হাবিব উত্তর দেন। জিহ্বা আমার ভিন্নভাষী। হৃদয় যে আমার আরবি। জগতের সৃষ্টা মাবুদ।

তিনি মানবের শরীর দেখেন না। দেখেন হৃদয়। তিনি বলেছেন, আমি মুমিন বান্দার হৃদয়ে বসত করি। আমরা যদি ছেলেবেলা থেকেই হৃদয়কে পবিত্র রাখি। তবেই দুই জীবনে মাবুদের বন্ধুত্ব পাব।

পৃথিবীখ্যাত সুফি গ্রন্থ তাজকিরাতুল আউয়ালিয়ার ভাব নিয়ে