নিরাপত্তা ঝুঁকিতে হাজারো মানুষের ব্যক্তিগত ‘ড্যাটা’
হাসান মাহমুদ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:২২ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২৪ শনিবার
বাংলাদেশে সাটডাউন গুপ্তচর সংস্থা ‘এনটিএমসি’র ওয়েবসাইট
বাংলাদেশে মানুষের সেলফোন, এক্স, টেলিগ্রাম, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমুতে আঁড়িপাতার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী গুপ্তচর সংস্থা ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার’ (এনটিএমসি)-এর বিরুদ্ধে। হাজার হাজার ফোনকল রেকর্ড করে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার মতো অসংখ্য ঘটনায় সংস্থাটি জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিগত সরকারের পতনের পর ‘এনটিএমসি’র ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে অবসরে পাঠানো হয়। তিনি দুবাই যাবার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়ে এখন পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন। এরপরই বদলে যেতে থাকে ‘এনটিএমসি’র সকল কার্যক্রম। ডিজি গ্রেপ্তারের পর ‘এনটিএমসি’র ওয়েবসাইট সাটডাউন করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কর্মকর্তাদের পদবি, ছবি, পরিচিতি, নাম, ফোন নম্বর রাখা ছিল। এনটিএমসি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের মনোভাব ইতিবাচক নয় বলে জানা গেছে। ‘এনটিএমসি’র এমন হাল অবস্থায় তাদের কাছে থাকা হাজার হাজার মানুষের অতি স্পর্শকাতর ড্যাটা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।
২০০৮ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স’ (ডিজিএফআই) ভবনে প্রথম যাত্রা শুরু করে এনটিএমসি’র গোয়েন্দা কার্যক্রম। ন্যাশনাল ইনফরমেশন পোর্টাল (এনআইপি)তে ঢুকে অনুমোদিত শতশত প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের যে ড্যাটা নিয়ে কাজ করে থাকে তার ওপর নজরদারি করতো এনটিএমসি। এছাড়া তারা সরকারের বিপক্ষে যায় এমন মানুষদের নজরদারিতে রেখে তাদের ব্যক্তিগত ড্যাটা সংগ্রহ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করতো।
বিগত সরকারের নির্দেশনা ছিল- দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থাকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে সহযোগিতা করতো এনটিএমসি। বিশেষ করে সরকার বিরোধিদের গতিবিধি নজরদারির মধ্যে রাখা হতো এনটিএমসির মাধ্যমে। তারা গোপনে টার্গেটকৃত ব্যক্তির ফোন কথোপকথন রেকর্ড করতো। এছাড়া টার্গেটকৃত ব্যক্তির নাম, পেশা, ন্যাশনাল আইডি নম্বর, সেল ফোন নম্বর, ব্যাংকের তথ্য, আর্থিক বিবরণ, রক্তের গ্রুপ, পিতা ও মাতার নাম, ফোন কলের দৈর্ঘ্য, গাড়ীর নিবন্ধন, পাসপোর্টের তথ্য, আঙুলের ছাপ এবং ওই ব্যক্তির একাধিক ছবি সংরক্ষণ করতো।
ক্লাউড ডিফেন্স নিরাপত্তা গবেষক ভিক্টর মার্কোপোলোস ‘এনটিএমসি’ সম্পর্কে বলেন, যে কোন গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটতে পারে। ভুল কনফিগারেশনের কারণে ‘এনটিএমসি’র ড্যাটাবেসের মধ্যে প্রকাশিত তথ্যের ১২০টিরও বেশি সূচক রয়েছে। যার প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন লগ সংরক্ষণ করা হয়। এসব সূচকে সেলফোন, এসএমএস, জন্ম নিবন্ধন, পিডস, বন্দি তালিকা, অনুসন্ধান, ড্রাইভিং লাইসেন্স, টেম্প এবং টুইটা’র তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফাইলগুলিতে হাজার হাজার তথ্য এন্ট্রি রয়েছে।’
নিরাপত্তা পরামর্শদাতা এবং তথ্য লঙ্ঘন অনুসন্ধান সংস্থা সিকিউরিটি ডিসকভারির সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরেমিয়া ফাউলার উন্মক্ত ড্যাটাবেজ পর্যালোচনা করেছেন এবং ‘এনটিএমসি’র সাথে এর লিঙ্কগুলি নিশ্চিত করেছেন। ফাউলার বলেন, ‘আমি নিয়মিতভাবে অনলাইনে উন্মুক্ত সার্ভার এবং ডেটাবেসগুলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তথ্যগুলো খুঁজে পেয়েছি।’ প্রতিটি সেলফোনের দেওয়া আইডেন্টিফিকেশন কোডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি দেখেছি তা সত্যিই বিপজ্জনক ছিল। তা হলো অনেকগুলো ‘আইএমইআই’ নম্বর। এগুলির সাহায্যে তারা আসলে একজন ব্যক্তির ফোনকে ট্র্যাক করতে পারতো বা ফোন নম্বর ক্লোন করতে পারতো। যার দ্বারা ওই ব্যক্তিকে তারা সর্বক্ষণ নিজেদের কব্জায় রাখতে সক্ষম হতো।
গত জুন মাসে বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত ড্যাটা ন্যাশনাল ইনফরমেশন পোর্টাল (এনআইপি) থেকে চুরি হয়ে একটি চক্রের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যায়। এনটিএমসি’র দাবি তারা তা শনাক্ত করতে পেরেছে। ‘এনটিএমসি’র সদ্য বিদায়ি ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত ড্যাটা চুরির বিষয়ে গত ৪ জুলাই ‘সাপ্তাহিক আজকাল’কে এক প্রশ্নের উত্তরে ফোনে জানিয়েছিলেন, ‘ন্যাশনাল ইনফরমেশন পোর্টাল (এনআইপি)তে ঢুকে কেউ ড্যাটা সরিয়ে নিয়ে বাইরে বিক্রির চেষ্টা করলে ‘এনটিএমসি’র পক্ষে তা জানার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আমাদের কাছে রয়েছে।’
সরকারের পটপরিবর্তনে ‘এনটিএমসি’র ভবিষ্যৎ কার্যক্রম কি হবে তা নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানা যায়। জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে নতুন কোন রূপরেখা আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।