এখনো পানিবন্দি ১২ লাখ পরিবার
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৮:১৬ এএম, ২৮ আগস্ট ২০২৪ বুধবার
দেশের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানিবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি মিলেছে ৩৩ হাজার ৬১৯টি পরিবারের। সোমবার পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮। মঙ্গলবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবারে। বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৭ জনের, আর ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন।
গতকাল মঙ্গলবার বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে চলমান ভয়াবহ বন্যার মধ্যেই ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। তবে এর ফলে এখন পর্যন্ত নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হয়নি। অধিকাংশ এলাকায় পানি নেমে যাচ্ছে। যেসব এলাকায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে সেগুলো রানিং পানি, দ্রুত নেমে যাবে বলে আশা করছি। এটা রাজনৈতিক বন্যা পরিস্থিতি কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দূরবর্তী সব উপজেলায় ত্রাণ পৌঁছানো গেছে। এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টিই আছে। বন্যায় কুমিল্লায় ১০ জন, ফেনীতে এক জন, চট্টগ্রামে পাঁচ জন, খাগড়াছড়িতে এক জন, নোয়াখালীতে পাঁচ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জন, লক্ষ্মীপুরে এক জন এবং কক্সবাজারে তিন জন মারা গেছেন। এছাড়া মৌলভীবাজারে দুই জন নিখোঁজ আছেন। উপদেষ্টা জানান, পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয়ের জন্য মোট ৩ হাজার ৮৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন লোক এবং ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে মোট ৬২০টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে।
ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, বন্যার্তদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছয় দিনে নগদ কালেকশন হয়েছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে ৬০ লাখ টাকার বেশি এসেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
কুমিল্লা-ফেনী-লক্ষ্মীপুরে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ধীরগতিতে পানি কমলেও কুমিল্লা ও ফেনীর প্রান্তিক গ্রামগুলোয় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, পোশাক, জরুরি ওষুধের সংকট। তবে দুর্গত মানুষকে সহায়তায় জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণসামগ্রীও আসছে। কিন্তু পরিবহনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নৌকা ও ট্রলার না থাকায় উপদ্রুত এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। এদিকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মনোহরপুর, অলুয়াচণ্ডিপুর, নাল্লা, শশীদল, শিদলাই, বড়ধুশিয়া, বাড়েশ্বর, বৃষ্টিপুর, বুড়িচং সদর, ষোলনল, পীরযাত্রাপুর, বাকশিমুল ইউনিয়নের প্লাবিত এলাকাগুলোয় এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোটে পানিবন্দি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বিপত্সীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফেনী নদীর তীরঘেঁষা গ্রামগুলোর বাসিন্দারা পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দি। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে গ্রামগুলোতে। একাধিক সংবাদকর্মী জানান, ফেনীর প্রত্যন্ত অনেক গ্রামে এখনো হাঁটু, আবার কোথাও বুকসমান পানি রয়েছে। এসব এলাকার বহু মানুষ ত্রাণ পায়নি। নৌকা দেখলেই তারা ত্রাণের জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, ভয়াবহ বন্যায় ইতিমধ্যেই তলিয়ে গেছে জেলার অধিকাংশ এলাকা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। এসব এলাকার গ্রামীণ সব রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সারা দেশ থেকে ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীরা লক্ষ্মীপুরের পাঁচটি উপজেলায় প্রবেশ করলেও এখনো ত্রাণ পাচ্ছেন না পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এসব নারী-শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সি মানুষ। জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরকারি ত্রাণসহায়তা দেওয়া হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে এখনো কোনো ত্রাণসহায়তা পৌঁছায়নি। এমন পরিস্থিতিতে বন্যার্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকুতি জানিয়েছেন হাজার হাজার বানভাসি পরিবার।
নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি, শিক্ষার্থীর মৃত্যু
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ ও উজানের পানির চাপে জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েছে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ও মানুষের চাপ। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায়, দোকানপাট বন্ধ থাকায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। কর্মহীন মানুষের কষ্টের শেষ নেই।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়েছে। এদিকে সোমবার বিকালে বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র, ঐ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের মো. সালাউদ্দিনের ছেলে সাব্বির আহমেদ (১৭) বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে জেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় নৌবাহিনী প্রধান
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করছেন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান। তিনি গতকাল মঙ্গলবার জেলার ফুলগাজী উপজেলা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে জনসাধারণের খোঁজখবর নেন এবং নৌ-কনটিনজেন্ট, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর তিনি নৌবাহিনীর বোটযোগে ফেনীর সামগ্রিক বন্যাকবলিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় উদ্ধার, ত্রাণসরবরাহ ও চিকিৎসা কার্যক্রমে নিয়োজিত নৌ-সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। পরিদর্শনকালে নৌবাহিনী প্রধান বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় যত দিন প্রয়োজন হবে তত দিন নৌবাহিনীর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
রায়পুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম পুরোপুরি পানিবন্দি রয়েছে। ভারী বর্ষণ ও মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বাড়ার কারণে উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ না পৌঁছায় দেখা দিয়েছে হাহাকার। এদিকে গতকাল বিকালে উপজেলার বামনী ইউনিয়নে আবুল হাসান নামের এক যুবক পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
লাকসামে দুই জনের মৃত্যু
লাকসাম (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সরকারি হিসাবে উপজেলার ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি। ৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪ হাজার বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণের সংকট রয়েছে। এদিকে গতকাল বন্যার্তদের পানি সরবরাহ করতে গিয়ে কাদ্রা গ্রামের খালেদ মাহমুদ শিহাব (২০) নামের এক মাদ্রাসাছাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। এছাড়া সোমবার আউশপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে মাকসুদা বেগম (৫৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
মৌলভীবাজারে ধীরগতিতে কমছে পানি
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানি জেলার উঁচু এলাকা থেকে নেমে যাওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরছেন। অনেক স্থানে বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। নিম্নাঞ্চল থেকে ধীরগতিতে পানি কমতে শুরু করেছে। মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জুড়ী নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্যসংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে।
চট্টগ্রামে ৬০ ইউনিয়ন প্লাবিত
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, জেলার ৭টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ফলে প্রায় ৩ লক্ষ ৪২ হাজার ২৮০ জন মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে এবং ২২ হাজার ৭১৬ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গত ২৩ ও ২৪ তারিখে বন্যায় ফটিকছড়ি উপজেলায় পানিতে ডুবে ৩ জন পুরুষ, হাটহাজারীতে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে ১ জন পুরুষ ও রাঙ্গুনিয়ায় পানিতে ডুবে ১ জনসহ মোট পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ অঞ্চলে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলছে।