বিভিন্ন দলের সঙ্গে কাল ড. ইউনুসের বৈঠক
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৩৬ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২৪ শনিবার
নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় সংলাপ আহ্বানের তাগিদ বিএনপি’র
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামীকাল ৩১ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশে সংস্কার প্রক্রিয়া, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধসহ সুশাসন কায়েমের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজনের জন্যে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই ক্ষেত্রে, অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চাইছে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ‘অস্পষ্ট’ হিসাবে অভিহিত করার পর বৃহস্পতিবার ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর মির্জা ফখরুল বলেছেন, দেশের জাতীয় নির্বাচন এবং বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপকভিত্তিক সংলাপ চায় বিএনপি। অপরদিকে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. আলী রীয়াজ বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশের সংবিধান পুনঃলিখনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
এদিকে, বেসামরিক এবং পুলিশ প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতির কারণে দেশে বেশ বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে দাবীদাওয়া নিয়ে কোন কোন মহলের উশৃঙ্খলতা মোকাবিলায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হচ্ছেন। এতে পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে এক উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি করছে। নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতিও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে শত শত হত্যা মামলা দায়ের করায় মামলাগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিশ^াসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে বলে আইনজীবিরা মত প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় বিএনপি : বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তী সরকার দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে এবং নির্বাচনের দিকেও যেতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বিএনপি। অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. ওঢাহিদউদ্দিন মাহমুদ, ড. আসিফ নজরুল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। প্রায় সোয়া এক ঘন্টা আলোচনা হয়েছে। আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকার দ্রুতই দেশকে স্থিতিশীল অবস্তায় নিয়ে আসতে পারবে বলে আশা করি। নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারণ করবেন।
সংবিধান পুর্নলিখনের সুপারিশ : বাংলাদেশ সফররত ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, এই নতুন সরকারের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বলেন, এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গণজাগরণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এ আশা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারের ওপর বিশাল দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সংবিধানের পুনঃলিখন। এর বাইরে আপনি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারবেন না। ফলে দুই মেয়াদ, তিন মেয়াদ এ প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, সেটা সবাই আলোচনা করে করতে পারে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দুই মেয়াদ যথেষ্ট। যেমনটি অন্যত্রও হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়াদের সময়সীমাটা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ ব্যবস্থায় এটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরী।
দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় : নতুন বাংলাদেশ গঠনে ৫৫টি সুপারিশ দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেখানে রয়েছে দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। পাশাপাশি, একই ব্যাক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা থাকতে পারবেন না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিজ দলের ওপর অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট ছাড়া আইন প্রণয়নসহ অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের সমালোচনা এবং দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাংক খাতে সংস্কারে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন, অর্থপাচার রোধে স্থায়ী টাস্কফোর্স গঠন, জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মচারিদের অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধে স্বার্থের দ্বন্ধ আইন প্রণয়ন, স্বচ্ছ নির্বাচন করতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু এবং রাষ্ট্র সংস্কারে অর্ন্তবর্তি সরকারকে কৌশলপত্র প্রকাশ করতে হবে।
এদিকে, বিগত শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যাক্তি, যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এমন সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কিনা তা জানা নেই। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার এক পিয়ন দুর্নীতি করে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়নি।
বিশৃঙ্খলা : এদিকে, বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। উভয় নেতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি ছাত্ররা পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে উপদেষ্টাদের বাধ্য করেছেন। আনসাররাও মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করে উপদেষ্টা ও কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ককে জিম্মি করেছিল। তখন ছাত্ররা সচিবালয়ে গিয়ে আনসারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করছে। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরে ঢুকে কর্মকর্তাদের অবরোধ করে করছে। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারী দফতরে চলছে এমন অরাজকতা।
সাংবাদিকদের নামে খুনের মামলা : অপরদিকে, কথায় কথায় দেয়া হচ্ছে খুনের মামলা। শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেবার পাশাপাশি সাংবাদিক, খেলোয়াড়, শিল্পীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের এসব খুনের মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধ দমনের ট্রাইব্যুনালেও হচ্ছে গণহত্যার মামলা। মামলাগুলো সরকার দায়ের না করলেও সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে। এসব মামলায় এমন সব আসামী দেওয়া হচ্ছে, যারা ঘটনার দিনে বিদেশে কিংবা অন্য কোথাও ছিলেন। ইতিমধ্যেই এসব মামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার সারা হোসেন। তিনি বলেছেন, এসব মামলার কারণে গণঅভ্যূত্থানের অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ঢালাও মামলা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনাম মনে করেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে সাংবাদিকের নামে মামলা হতে পারে; কিন্তু ঢালাও খুনের মামলা অগ্রহনযোগ্য।