ইনফেকশনে কাটা পড়ছে হাত-পা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৫০ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বুধবার
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আন্দোলনে আহতরা
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে নির্বাক তাকিয়ে তামিম (১৪)। চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। বালিশের ওপরে রাখা ব্যান্ডেজ জড়ানো পা। গত ৫ আগস্ট মিরপুর-২ এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন। অপারেশন করা হলেও সঠিক পরিচর্যার অভাবে ইনফেকশন হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ডান পা কেটে ফেলতে হয়। বরিশাল দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তামিম এখন পঙ্গু।
তামিমের মামা তানভীর আহমেদ বলেন, পঙ্গু হাসপাতালে তামিমের পায়ে অপারেশন করা হলেও ঠিকমতো ড্রেসিং করানো হয়নি। ওই সময় নার্সদের ডেকে আনা যেত না। এমন অবহেলার কারণে ইনফেকশন হয়ে যায় তামিমের পায়ে। বাধ্য হয়েই অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয় পা।
তামিমের মতো আন্দোলন সংঘর্ষে আহতদের আরও অনেকে ইনফেকশনে অঙ্গহানির শিকার হচ্ছেন। ইনফেকশন ঠেকাতে নানানরকম উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অধিকাংশ হাসপাতাল। নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে এই আহতদের রাখা হয়েছে। রোগীর অ্যাটেনডেন্ট নির্দিষ্ট করা, এমনকি প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও ইনফেকশনের শঙ্কা কাটছে না।
তীব্র যন্ত্রণায় কাতর ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আল ইমরান। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর কদমতলী এলাকায় বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ২০ জুলাই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি হওয়ার পর থেকে ১০ বার অপারেশন হয়েছে ইমরানের পায়ে।
ইমরানের মামা শান্ত আহমেদ বলেন, ‘সারা রাত ব্যথায় চিৎকার করে ইমরান। ওর পায়ে ৬ ইঞ্চি বুলেট ঢুকে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ায় হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে। অপারেশনের পর ওয়ার্ডে থাকাকালীন ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়। এখনো তিনটা আঙুল নাড়াতে পারছে না। চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন পা যেন কাটতে না হয়। পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।’
আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসাসেবা সুনিশ্চিত করতে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আলাদা বিশেষ ইউনিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ১৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে বলা হয়, আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতা নানাভাবে আহত হয়েছেন এবং তাদের অনেকেরই অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই তাদের অস্ত্রোপচার পরবর্তী সংক্রমণের প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। স্পেশালাইজড ইউনিটগুলোতে রোগীর স্বজন বা বৈধ প্রতিনিধি পরিচালকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু এসব নিয়ম করলেও ঠেকানো যাচ্ছে না ভিড় এবং সংক্রমণ।
গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি বেডে চিকিৎসাধীন সবাই আন্দোলনে গুলি কিংবা রাবার বুলেটে আহত। কারও পেটে ঢুকে বিস্ফোরিত হয়েছে বুলেট, আবার কারও কোমরে বুলেটের ক্ষত। এই রোগীদের দেখতে স্বজনদের পাশাপাশি আসছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন এনজিও। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগেও আর্থিক সাহায্য করতে কিংবা রোগীদের খবর নিতে আসছেন হাসপাতালে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রিফাত। তার বাবা মাহমুদ তরফদার বলেন, ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অপারেশন করে গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করেছেন ইনফেকশনের ব্যাপারে। কিন্তু বিভিন্ন মানুষ খোঁজ নিতে আসে ভালোবেসে, তাদের তো না করতে পারি না।’
সম্প্রতি ঢামেক হাসপাতালে আহত রোগীদের দেখতে গিয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেছেন, ঢালাওভাবে সবাই আহতদের চিকিৎসাধীন কক্ষে প্রবেশ করবেন না। একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে অনেকেই আছে যাদের ক্ষতস্থানে পুনরায় ইনফেকশন হয়েছে।