বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

যুক্তরাষ্ট্রে বসে আসামি, গুলি হয়েছে ঢাকায়

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৮:৩৭ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

ঘটনার সময় ছিলেন আমেরিকায়। পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন বিভাগের দেওয়া সই স্বাক্ষরেও রয়েছে তার প্রমাণ। অথচ ওই ব্যক্তিকেই করা হয়েছে সবুজ হত্যা মামলার আসামি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকায় শহিদ হন ভোলার লালমোহন উপজেলার বাসিন্দা এই সবুজ। কেবল একজন নয়, হত্যার ওই ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় হওয়া মামলায় এমন অনেককে আসামি করা হয়েছে যারা তখন ছিলেন না ঢাকায়। এদের মধ্যে অন্তত ৭ জন বিএনপি’র পরীক্ষিত নেতা-কর্মী। ৯৮ জনের নাম উল্লেখসহ ৫শ’ জনের বিরুদ্ধে হওয়া এই মামলার আসামিদের প্রায় সবার বাড়ি লালমোহনে। রাজনীতির পথের কাঁটা সরাতে মামলায় পরিকল্পিতভাবে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে বলছেন সেখানকার বিএনপি নেতা-কর্মীরা। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে লালমোহন বিএনপিতে সৃষ্ট সংস্কারপন্থি-মূলধারা দ্বন্দ্বের প্রভাবও রয়েছে এখানে বলছেন তারা।

৪ আগস্ট ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন লালমোহনের সবুজ হোসেন (২২)। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। এই ঘটনায় গত ১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই লালমোহনের বিএনপি কর্মী মনির হোসেন। মামলার খবর লালমোহনে পৌঁছতেই শুরু হয় তোলপাড়। অন্যদের নিয়ে কোনো জটিলতা না থাকলেও আসামির তালিকায় থাকা ৭/৮ জন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে স্থানীয় বিএনপি। এসব পরীক্ষিত নেতাদের কেন আসামি করা হল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মেলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে স্থানীয় বিএনপিতে চলা সংস্কারপন্থি-মূলধারা দ্বন্দ্বের কারণেই তারা আসামি হয়েছে বলছেন অনেকে। রাজনীতি থেকে এদের সরাতে পারলে সংস্কারপন্থিদের পথের কাঁটা দূর হবে বলছেন তারা।

একসময় উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব ছিলেন আক্তারুজ্জামান টিটব। রাজনীতিতে সেখানকার সাবেক এমপি হাফিজের বিরুদ্ধ পক্ষ তিনি। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচন করায় ২০১৪ সালে বহিষ্কার হন দল থেকে। এরপর থেকে রয়েছেন সেই অবস্থায়। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে স্বতন্ত্র উপজেলা চেয়ারম্যান হন টিটব। বিএনপি ঘরানার জনপ্রিয় এই নেতাকে করা হয়েছে সবুজ হত্যা মামলার ৩ নং আসামি। কেবল তিনি নন, তার আরও দুই ভাইকেও করা হয়েছে আসামি। যাদের একজন রাশেদুজ্জামান ঘটনার সময় ছিলেন আমেরিকায়। পাসপোর্টের তথ্যানুযায়ী ২৫ জুলাই সেখানে যান রাশেদ। দেশে ফেরেন ৯ আগস্ট। মামলার আরেক আসামি টিটবের ভাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান। লালমোহন পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মনিরকে ২০১০ সালের পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। যুগান্তরকে টিটব বলেন, ‘ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে তখন আমি ছিলাম এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজেও রয়েছে। তারপরও আসামি করার বিষয়টি দলের অভ্যন্তরীণ সাইজিকরণ প্রকল্প। ওয়ান ইলেভেনে আমরা যারা মূলধারায় ছিলাম তাদেরকে রাজনীতি থেকে বিদায় দিতে এটা করা হয়েছে। তখন যারা সংস্কারে গিয়ে মাইনাস টু ফর্মুলায় ছিল তারাই করেছে এটা।’

বিতর্কিত এ মামলায় আসামি করা হয়েছে লালমোহন উপজেলা বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা-কর্মীকে। এদের একজন লালমোহন উপজেলা যুবদলের সহ-সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন শিপলু। ১৯৯৪ সালে ছাত্রদলের সমাজকল্যাণ ও আপ্যায়ন সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে আজ অবধি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিপলু বলেন, ‘কেবল আমি নই, আরও আসামি করা হয়েছে লালমোহর উপজেলা যুবদলের সদস্য এবং চরভুতা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. মোসলেহ উদ্দিন হাওলাদার এবং বিএনপির একনিষ্ঠ কর্মী মো. শামসুদ্দিন ও তার ছেলে মো. রাসেলকে। যেদিন ঢাকায় সবুজ শহিদ হন, সেদিন আমরা সবাই ছিলাম লালমোহনে। ১ সেপ্টেম্বর হঠাৎ খবর পাই আমাদেরকে সবুজ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি উপজেলা বিএনপি’র বর্তমান সদস্য সচিব শফিকুল ইসলাম বাবুল পঞ্চায়েতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মামলাটি করেছে মনির। পরিকল্পিতভাবে সেখানে আমিসহ অন্যান্য বিএনপি নেতা-কর্মীদের করা হয়েছে আসামি।’ মামলার আরেক আসামি মোসলেহউদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামি ৯৮, এরমধ্যে ৮৭ জনের বাড়ি লালমোহনে, বাকি ১১ জন ঢাকার। মনে হয় যেন ৪ আগস্ট সবুজ মোহাম্মদপুরে থাকবে সেটা জেনে লালমোহন থেকে সবাই লঞ্চ-বাস বোঝাই হয়ে সেখানে গেছে তাকে মারতে। অথচ শহিদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সবুজকে আমরা কেউ ভালো করে চিনতামও না। এটা আসলে ওয়ান ইলেভেনকালীন সময় থেকে এখানে চলমান সংস্কারপন্থি-মূলধারা বিরোধের ফসল। বিষয়টি অভিযোগ আকারে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সব পর্যায়ের নেতাদের জানিয়েছি।’

বিএনপির কর্মী হয়ে করা মামলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী লালমোহনের পশ্চিম চর উমেদ এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, ‘আমি যা শুনেছি দেখেছি সে অনুযায়ী আসামি করা হয়েছে।’ এজাহারে আপনি লিখেছেন আপনার ভাই সবুজ গুলিবিদ্ধ হয়েছে শুনে হাসপাতালে গিয়ে তাকে পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে হামলা গুলিবর্ষণ কীকরে দেখলেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে যারা ছিল তারা আমায় বলেছে।’ ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন লালমোহন উপজেলার এত মানুষকে চিনল কী করে জিজ্ঞেস করলে অবশ্য তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। মামলার আসামির তালিকায় থাকা রাশেদুজ্জামান ঘটনার সময় আমেরিকায় ছিলেন, তিনি কীভাবে গুলি করলেন জানতে চাইলে মনির বলেন, ‘এরকম একটি হত্যার ঘটনায় অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে, হত্যার হুকুমদাতা-পরিকল্পনাকারী থাকতে পারে। আমি মামলা করেছি। এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখবে যে কারা প্রকৃত দোষী।’ মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বিএনপি’র কোনো নেতার সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু তাদের নাম বলতে আমি বাধ্য নই।’ সংস্কারপন্থিদের দমনে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে এবং আপনার তত্ত্বাবধানে তা হয়েছে এমন অভিযোগের জবাবে লালমোহন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘যিনি শহিদ হয়েছেন তার ভাই এই মামলা করেছে। এখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা কেন আসামি হয়েছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। হয়তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। সে কারণেই তাদেরকে আসামি করা হয়েছে। তদন্তেই সব প্রমাণ হবে।’