বৃহস্পতিবার   ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ৪ ১৪৩১   ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত

সংস্কার ও সংলাপের পর নির্বাচন

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:১৪ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শনিবার




রাষ্ট্র সংস্কারের পর রাজনৈতিক সংলাপ এবং এরপর নির্বাচনে যাবে সরকার। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাব মুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বত্র সংস্কারের ঢেউ লেগেছে। নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার, রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি, অর্থনীতিকে জোরদার করা বন্ধ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। নির্বাচন কমিশনে ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশে সরফরাজ হোসেন, বিচার বিভাগে শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুদকে ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসনে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধানে ড. শাহদীন মালিককে প্রধান করে কমিশনগুলো ঘোষণা করা হয়েছে। তারা তিন মাসের মধ্যে সংস্কার করার জন্যে সুপারিশ প্রণয়ন করবেন। সেটা বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংস্কারের জন্য সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, সেগুলো তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে আশা করছে সরকার। তারপর এক পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে যাবে সরকার। ওই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার, সুনির্দিষ্ট কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে তারপর নির্বাচনের কথা ভাবছে সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের এই ঢেউয়ের মধ্যেই আবার বিভিন্ন স্থানে চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনে আওয়ামী লীগপন্থীদের সরিয়ে দিয়ে ব্যাপক রদবদল করার সময় সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ৫৯জন জেলা প্রশাসককে নিয়োগ দেবার পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে মারামারির ঘটনা ঘটে। বিএনপি-জামায়াতপন্থী জুনিয়র কর্মকর্তারা ডিসি পদে আওয়ামী লীগপন্থীদের নিয়োগ দেবার অজুহাতে একজন যুগ্ম সচিবের ওপর হামলা চালায়। তাকে মারধোর করে। এসব ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের কেন্দ্রস্থলে এসব ঘটনার পর দেশের অন্যান্য স্থানেও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সাভার ও আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও নাজুক। জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। রাস্তা বন্ধ করে দাবির মিছিলও চলছে।
রাজনৈতিক অঙ্গন নানামুখি আলোচনায় মুখর। বিএনপি দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন দেবার দাবি জানিয়েছে। যদিও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকার গঠনের কথাও বলছেন। তবে মাঠে বর্তমানে দ্বিতীয় শক্তিশালী দল জামায়াতে ইসলামী ধীরে সুস্থে সংস্কার সম্পাদনের পর নির্বাচন করার কথা বলছে। জামায়াত দলকে গোছাতে চাইছে আগে। ছাত্র-জনতাও একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কী মেরুকরণ দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। তার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।  তার মেডিকেল বোর্ড তাকে বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিভিন্ন মামলায় বিচারের পাশাপাশি বাড়ছে মব ট্রায়ালের আশঙ্কা। এমন আশঙ্কায় সীমান্তে অবৈধ পথে ভারত পালাতে নিয়ে অনেকে আটক হচ্ছেন। সর্বশেষ সীমান্তে আটক হয়েছেন সাবেক এমপি ফজলে করিম। শেখ হাসিনার একটি কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই কলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত তানভীর নামের এক নেতাকে বলতে শোনা গেছে যে, তিনি বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই আছেন। যে কোনও সময় চট করে বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পারেন। এদিকে, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে বিচারের আয়োজন চলছে। এই বিচার কার্যকর করতে হলে শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন হতে পারে। ধারণা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার তাকে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রত্যার্পণ চুক্তির আওতায় ফেরত চাইতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে যে, শেখ হাসিনা যেন ভারতে থেকে কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন করে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃবৃন্দ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আজকালকে বলেছেন, পূর্ববর্তী সরকার সবসময় বলার চেষ্টা করেছে যে, ভারতের সঙ্গে সোনালী অধ্যায় চলছে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেটা সব সময় যে মানুষের প্রত্যাশা এবং মানুষের যে অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে এমন নয়। মানুষের এমন পারসেপশন আছে যে, বিগত সরকার অনেক বেশি ভারতমুখী ছিলো। উপদেষ্টা বলেন, আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চাই। এতে কোনও সন্দেহ নেই। বাকি সবার সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক চাই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের এক ধরনের টানাপোড়েন চলছিলো। সেটা আমরা চাই না। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার। আমাদের রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য। কাজেই আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক একইভাবে ভারসাম্যপূর্ণ থাকুক।
ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আসছেন : ডোনাল্ড লু-এর সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। আমি সার্বিকভাবে শুধু বলতে পারি যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হবে। আমরা তাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চাই। তার সঙ্গে ট্রেজারি বিভাগের প্রতিনিধিও আসছেন। তারাও মিটিং করবেন। অর্থনৈতিক বিষয়দিও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগাব।
গণহারে খুনের মামলা নিয়ে উদ্বেগ : বাংলাদেশে গণহারে খুনের মামলা দায়ের করা হচ্ছে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে খুনের মামলা হচ্ছে। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের নামেও খুনের মামলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এর এক সভা বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় সাংবাদিকদের গণহারে হত্যা মামলার আসামী করায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।