শনিবার   ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ৫ ১৪৩১   ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্যাম্পাসে পিটিয়ে হত্যায় স্তম্ভিত বাংলাদেশ

ঢাকা অফিস

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৪ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শনিবার

 

 


বাংলাদেশের দুইটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে দুই ব্যাক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গোটা বাংলাদেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ব্যক্তিকে মোবাইল ফোন চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যাক্তিকে প্রথমে এক দফা গণপিটুনি দেওয়া হয়। তারপর তাকে খেতে দেয়া হয়। পরে আবার বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে এমনভাবে পেটানো হয় যে, ওই ব্যাক্তি তখন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এই ঘটনা যখন মানবিকতার চরম বিপর্যয় হিসাবে দেখা হচ্ছে; ঠিক ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সিন্ডিকেট এক বৈঠকে বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অপরদিকে, একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন প্রাক্তন নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করে শিক্ষার্থীরা। দুই বিশ^বিদ্যালয়ের ঘটনা মানবিকতা ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয় বলে মনে করা হচ্ছে। গণপিটুনির মাধ্যমে এভাবে মানুষ হত্যার ঘটনায় ধিক্কার জানাচ্ছেন সবাই। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিচারের দাবি করেছেন অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বুধবার রাতে শিক্ষার্থীদের মারধরে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। চোর সন্দেহে তিন ধাপে তার ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ঢাবি প্রশাসন জড়িতদের বিচারের আওতায় আনারও ঘোষণা দিয়েছে। গঠন করেছে তদন্ত কমিটি, করেছে মামলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগ থানা পুলিশ বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন নির্মমতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তোফাজ্জল হোসেন পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার মা, বাবা ও বড় ভাই মারা যান। প্রেমিকাও তাকে ছেড়ে গেলে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। ঘুরতেন রাস্তায় রাস্তায়। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেই তিনি হয়তো সেখানে গিয়েছিলেন। পিটিয়ে মারার আগে তোফাজ্জল হোসেনকে ভাত খেতে দেয় শিক্ষার্থীরা। তিনি বুঝতে পারেননি, এই খাওয়াই তার শেষ খাওয়া।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার দুপুরে হলের মাঠে শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট খেলা চলাকালে ছয়টি মোবাইল ফোন চুরি হয়। রাত ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে ঢুকলে চোর সন্দেহে তাকে ধরে ফেলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বললে তাকে অতিথিকক্ষে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মারধর করেন কয়েকজন। এরপর হলের ক্যান্টিনে রাতের খাবার খাওয়ানো হয় তাকে। পরে হলের এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে ফের মারধর করা হয়। সেখান থেকে আবার প্রধান ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে তৃতীয় দফায় মারধর করা হয়। নির্যাতনে শরীরের কোথাও কোথাও তার মাংস পর্যন্ত খুলে পড়ে। রাত সাড়ে ১০টায় শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে মারা যান তোফাজ্জল।
গ্রেফতার শিক্ষার্থীরা হলেন-ছাত্রলীগের হল শাখার উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক থেকে পদত্যাগ করা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ; মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মোত্তাকিন সাকিন। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেন আল হুসাইন সাজ্জাদ, আহসান উল্লাহ ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, তোফাজ্জলকে আঘাত করার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় এদের গ্রেফতার করা হয়। মোবাইল ফোন হারানো এক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে জানান, দুপুরে আমাদের ছয়জনের মোবাইল খেলার মাঠ থেকে চুরি হয়ে যায়। এরপর আমরা শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। রাতে তোফাজ্জল নামের একজন ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে আটক করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাকে কিছু শিক্ষার্থী মারধর করে। এরপর হাউজ টিউটর ও প্রক্টরিয়াল বডির সাহায্যে তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তোফাজ্জল হেঁটে গাড়িতে ওঠেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন জালাল আহমেদ। তিনি কিছু করেননি দাবি করে বলেন, আমাকে হলের হাউজ টিউটররা সেখানে গিয়ে দেখতে বলেন কী হচ্ছে। তবে কাউকে মারধর করিনি। বরং একজন জুনিয়র স্টাম্প দিয়ে মারধর করতে গেলে তাকে থামানোর চেষ্টা করি।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মারধরের ঘটনায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সেশনের শিক্ষার্থীরা জড়িয়েছে। এদের মধ্যে কারও ভূমিকা ছিল আক্রমণাত্মক আবার কারও ছিল রক্ষণশীল। তাদের অভিযোগ তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি মারধর করেছেন জালাল আহমেদ, মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন। এরা সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মারধরে জড়িত ছিলেন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের রাশেদ কামাল অনিক, গণিত বিভাগের রাব্বি এবং সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল। এছাড়া অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন হল ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপসম্পাদক আহসান উল্লাহ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আল হোসাইন সাজ্জাদ। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সাজ্জাদ তোফাজ্জলের আঙুলের মাঝে স্টাম্প রেখে তার ওপর শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়ায়। এসব অভিযোগের পক্ষে যুগান্তরের হাতে বেশ কয়েকটি ভিডিও এসেছে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হল গ্রুপে ৮টার সময় দেখি চোর ধরা পড়েছে। হলের গেস্টরুমে গিয়ে দেখি চোর বসা। রুমে তখন প্রথম বর্ষ-দ্বিতীয় বর্ষের অনেক ছেলে ছিলেন। গেস্ট রুমে তাকে বেশি মারা হয়নি। ওখানে হালকা মারার পর ক্যান্টিনে নিয়ে আসে খাওয়ানোর জন্য। তারপর শুনি চোরকে এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি ওখানে গিয়ে দেখি ’২০-২১, ২১-২২ ও ২২-২৩ সেশনের ব্যাচ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন। ’২০-২১ আর ’২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থীরা খুব বেশি মেরেছে। পরে সেখান থেকে তাকে মেইন বিল্ডংয়ের গেস্টরুমে আনা হলে আবারও তাকে সিনিয়র-জুনিয়র সবাই মিলে মারধর করে।
ঢাবির মামলা : শাহবাগ থানায় বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ৭টা ৪৫ মিনিটে একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাকে আটক করেন। পরে তাকে প্রথমে হলের মূল ভবনের গেস্টরুমে নিয়ে তিনি মোবাইল ফোন চুরি করেছে বলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিলঘুসি মারে। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করলে তার নাম তোফাজ্জল বলে জানান। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বুঝতে পেরে তাকে হলের ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে হলের গেস্টরুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্টাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানানো হলে তারা সহায়তা করে অচেতন যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি : বিষয়টি তদন্তের জন্য ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলমগীর কবীরকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম খান, অধ্যাপক ড. শেখ জহির রায়হান, মো. মাহাবুব আলম, ড. আছিব আহমেদ আবাসিক শিক্ষক, সহকারী আবাসিক শিক্ষক ড. এমএম তৌহিদুল ইসলাম, সহকারী প্রক্টর (বিজ্ঞান অনুষদ) এ. কে. এম. নূর আলম সিদ্দিকী। প্রথমে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় সেই সময় আজ (শুক্রবার) সকাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, কেউ চুরি করতে এলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। আমরা সিসিটিভি ও অন্যান্য ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। তদন্ত কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা চারজনকে থানায় পাঠিয়েছি। তদন্ত কমিটির কাছে আরও তথ্য আসছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তাই তাদের সময়টা বৃদ্ধি করে কালকে (শুক্রবার) সকাল পর্যন্ত করা হয়েছে।
ঢাবি প্রশাসনের দুঃখ প্রকাশ : চোর সন্দেহে যুবক হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে সুবিচার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বদ্ধপরিকর বলে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সব মহলকে আশ্বস্ত করা যাচ্ছে যে, এ বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বদ্ধপরিকর।
পুলিশের সংবাদ সম্মেলন : মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, নিহতের সুরতহাল এবং পোস্টমর্টেম সম্পন্ন হয়েছে। লাশ তার আত্মীয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি পুলিশের কাছে ৬ জনকে হস্তান্তর করেছে। তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বিস্তারিত তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে দায়ী করেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশকেও দায়ী করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য কী? এমন প্রশ্নে ডিসি বলেন, কারা ঘটিয়েছে এবং কী কারণে ঘটিয়েছে সেটি তদন্তের বিষয়। আশা করি তদন্তের মাধ্যমে সবকিছু বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে ডিবির টিমও কাজ করছে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে হত্যা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ বুধবার ক্যাম্পাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিকালে ও সন্ধ্যায় তাকে গণপিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা। তবে মারধরের নেতৃত্ব দেয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এটিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা আখ্যা দিয়ে জড়িতদের বিচার দাবিতে গভীর রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে বৃহস্পতিবারও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে চলে বিক্ষোভ। এর মুখে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। তবে তখন পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি। কাউকে আটক বা গ্রেফতারের তথ্যও পাওয়া যায়নি।
নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি আশুলিয়া থানার কাঠগড়া এলাকার মোল্লাবাড়ীর ইয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকসংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে। ১৫ জুলাই রাতে জাবি উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকা এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে গুলি ছোড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান লাবীব। হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলে শামীমকে গণধোলাই দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভূঁইয়ার নির্দেশে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আতিককে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।
খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় শামীমকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। তাকে নিরাপত্তা শাখায় আনার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সেখানে জড়ো হয়। সেখানেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন শামীমকে নিরাপত্তা শাখার ভেতরে নিয়ে গেটে তালা দিয়ে রাখা হয়। তবে গেটের তালা ভেঙে তাকে আবারও গণধোলাই দেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তা থেকে নিরাপত্তা অফিসের তালা ভাঙা ও শামীমকে বেধড়ক মারধরে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ ও ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজন হাসান, ইংরেজি ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হামিদুল্লাহ সালমান এবং কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এমএন সোহাগ। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এছাড়া সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককেও দেখা গেছে, তবে তারা মারধরে অংশ নিয়েছে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান প্রক্টর অফিসে আসেন। তিনি উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শামীমের শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন। পরে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের খবরে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল নিরাপত্তা শাখায় আসেন। পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়ে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর তাকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ শামীমকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শামীম মোল্লার মৃত্যুর বিষয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান বলেন, ‘তাকে (শামীম) রাত সোয়া নয়টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আমরা পরীক্ষা করে জানতে পারি, উনি মারা গেছেন। মূলত উনি আগেই মারা গিয়েছিলেন। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তা ময়নাতদন্ত করে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের থেকে খবর পেয়ে আমাদের আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল ক্যাম্পাসে যায়। তারা আমাদের কাছে শামীম মোল্লা নামে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে সোপর্দ করে। সে শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে আহত ছিলেন। তাই তাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
ময়নাতদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শামীম মোল্লার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু রিপোর্ট আমরা এখনো হাতে পাইনি। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম বলেন, ‘শামীম মোল্লাকে যখন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন সে হেঁটেই গাড়িতে ওঠে। তবে কিছুক্ষণ পর পুলিশের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হবে। তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।’
বিক্ষোভ, বিচার দাবি : বুধবার রাত ১২টার দিকে শামীমের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাত দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, ‘স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা বিচারবহির্ভূত যে কোনো হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে। কেউ যদি অপরাধ করে তাহলে তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু কাউকে বিচারবহির্ভূতভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলাকে আমরা সমর্থন করি না।’
একই দাবিতে বৃহস্পতিবার পৃথক তিনটি ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া মঞ্চ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী শাসনামলে রাজনীতি করার অন্যতম প্রক্রিয়া ছিল লাশের রাজনীতি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি লাশ পড়েছে যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন রাজনীতি। যারা রাজনীতি শুরু করেছে তারা মূলত স্বৈরাচারের দোসর অথবা তাদের প্রক্রিয়া স্বৈরাচারেরই মতো। বুধবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে জড়িয়ে এই প্ল্যাটফর্মকে বিতর্কিত করার অপপ্রচেষ্টা চালানোর ঘটনায় নিন্দা জানাই।’
শামীম মোল্লার মৃত্যু ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ অ্যাখ্যা দিয়ে এদিন দুপুর ১২টায় জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে ও বিকাল সাড়ে তিনটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পৃথক দুটি বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা।