রোববার   ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ১৩ ১৪৩১   ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নতুন ভোটার তালিকা হলেই নির্বাচন:ড.ইউনূস

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫৪ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শনিবার


 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের আলোচনা শুরু হয়েছে। আগামী দেড় বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন করার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। চারদিকে কানাঘুষা ছিলো। অর্ন্তবর্তি সরকার কত দিন থাকবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিরাট সংস্কার করতে গেলে কত সময় লাগবে। এই রকম নানা বিষয়ে গুজব ডালাপালা মেলেছিলো। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে স্বস্তি ফিরলো। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। দলগুলো নির্বাচলের রোডম্যাপ দাবি করেছে। এদিকে, ভোটার তালিকা গত বছর করা হলেও হালনাগাদ করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করার পর নতুন কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা যাচ্ছে না। এদিকে, নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাঁর নেই।
নির্বাচনের সময়সীমার ধারণা সম্বলিত সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর পরই রাজনীতিতে নির্বাচনী আলাপ শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় সংস্কারও সীমাহীন হবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিয়েছে। তবে সংস্কারের নামে কালক্ষেপন করা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংস্কার ও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা জরুরী। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলেই একক নাকি জোটগত ভোট - সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যৌক্তিক সময় সীমার মধ্যে ভোট দিতে হবে।
অর্ন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে নিউইয়র্কে মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে এক বৈঠকে অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে ভোটার তালিকা তৈরি হয়ে গেলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এর আগে সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান যে কোনো পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকারের কথা জানান। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য  গুরুত্ব¡পূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এ সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।  প্রধান উপদেষ্টা ও  সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া গেল বলে কোনো কোনো দল মনে করছে। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে এখনই কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবে না বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে দলীয় বক্তব্য তুলে ধরে মঙ্গলবার দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা যেটা বলেছি, খুব লম্বা সময়ও নয়, স্বল্প সময়ও নয়-শুধু একটা নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু করতে যে সময়, সেই সময়টুকুই নেওয়া উচিত। দিন-মাস-ঘণ্টা এখনই বেঁধে দেওয়ার মতো ম্যাচুরিটি আসেনি। পরিস্থিতি আরেকটু পরে গেলে হয়তো নির্দিষ্ট দিনের কথা বলতে পারব। আরেকটু দেখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের মাত্র দেড় মাস সময় হলো। অনেক সংস্কার প্রয়োজন নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য। আরেকটা কথা হলো, রাষ্ট্রে সংস্কার অনেকগুলো, সেগুলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা করতে পারবেন। কিন্তু অরাজনৈতিক এ অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজ হলো একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যে সংস্কারটুকু দরকার-জনপ্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে আছে, এ জায়গায় হাত দিতে যেটুকু সময় লাগে, সেটুকু সময় নেওয়াই উচিত। তাহলে জাতি বুঝতে পারবে কোন সময় গ্রহণযোগ্য। এখানে মাস-দিন-ঘণ্টার চেয়ে পরিস্থিতিটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। সেটুকুকেই আমরা যৌক্তিক বলে মিন করেছি।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ¬বী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমি মনে করি, অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাবাহিনীর প্রধানের বক্তব্যে দেশবাসী আশ্বস্ত হবে। নির্বাচনের জন্য এক থেকে দেড় বছর লাগবে বা সময়টা কী হবে, তা সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ জরুরি। নির্বাচন কমিশনই এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি। নির্বাচনি ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই কাজগুলো করার সঙ্গে নির্বাচন করাটা জড়িত।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশে যে ক্রইসিস, সেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অতুলনীয়। আমরা একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম, আমাদের সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন যাতে হতে পারে, এটা আমাদের জন্য একটা ইতিবাচক দিক। কতদিন লাগতে পারে, কী হতে পারে-এসব প্রশ্ন কাজ করছিল, সেখানে একটা গাইডলাইন পেয়েছি। আর প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকেও ইতিবাচকভাবে দেখি। নির্দিষ্ট তারিখটা কবে হবে, সেজন্য কিছু হোমওয়ার্ক আছে, কিছু সংস্কার আছে-এসব গুরুত্বপূর্ণ। ভোটার হালনাগাদ খুব একটা কঠিন ব্যাপার না। কারণ, সব ডিজিটালাইজড। নির্বাচনি সংস্কারের বিষয়গুলো যে কমিশন করেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে সময় দিয়ে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে যদি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেন, আমাদের পজেটিভ বিষয়গুলো দেব। তা যদি ওনাদের বিবেচনায় নেন, আমার মনে হয় দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। তারিখ তো সরকারই দেবে, নির্বাচন কমিশনই দেবে। নতুন নির্বাচন কমিশনও তো নিতে হবে। কিছু কাজ তো আছেই।
নির্বাচনি প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। প্রস্তুতি তো আছেই। এখন নির্বাচনি ঐক্য হবে কি হবে না-এসব বিষয় আরও পরে বলা যাবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, নির্বাচন কবে হবে, তা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করার পরে সরকারকে ঠিক করতে হবে। নির্বাচন তো সবারই চাওয়া। যত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া যাবে, তত দ্রুত দেশের জন্য মঙ্গল হবে। যত দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন করা যাবে, ততই দেশের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাবে। আমরা প্রত্যাশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা নির্বাচন দেবে।
দেশের সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়ে গেলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। বর্তমান বাংলাদেশ একটি নতুন দেশ। নতুন সরকার গঠনের পর নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতিবিরোধী এবং সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করা হলে এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। আইএমএফের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এই উদ্যোগে ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানান। ঋণদাতা সংস্থা এই সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়টি দ্রুত ‘ট্র্যাক করবে’ জানিয়ে জর্জিয়েভা বলেন, তিনি বাংলাদেশে আইএমএফের একটি দল পাঠিয়েছেন এবং দলটি এখন ঢাকায় রয়েছে। আগামী মাসে দলের সদস্যরা আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদের কাছে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দেবেন।