বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গুজবের সাগরে ভাসছে বাংলাদেশ

মনোয়ারুল ইসলাম/মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:১২ এএম, ১২ অক্টোবর ২০২৪ শনিবার

সাধারন মানুষ উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত

 
 

গুজব মোটেও ঠেকানো যাচ্ছে না। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনও ভুল করে, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে অপতথ্য ছড়িয়ে কিংবা কখনও সঠিক তথ্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামাজিক মাধ্যমে রটানো হচ্ছে। রাজনীতি কিংবা ধর্মীয় উসকানিসহ নানা মিথ্যা তথ্যে সয়লাব সোস্যাল মিডিয়া। রীতিমত গুজবের সাগরে ভাসছে বাংলাদেশ। এসব নিয়ে সাধারন মানুষ খুবই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। যদিও প্রথম সারির সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল এসব তথ্য পরিবেশন করছে না। তবুও অনেক কিছুই ভাইরাল হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ার পোষ্টে ছবি কিংবা ভিডিও এডিট করে জুড়ে দেয়া হচ্ছে। তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের দাবি ঘিরে গত মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে গুজব ছড়িয়েছেন। বাংলাদেশে তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের কথিত দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে অন্তত আটটি গুজব প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে। রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার সম্ভাব্য শুরু মঙ্গলবার। বেলা তিনটার কিছু পর ফেসবুকের কিছু পোস্টের ভাষ্য এমন ছিল, ‘হটাৎ ঢাকা যমুনাতে সেনাবাহিনী টাংক  নিয়ে বসে আছে ব্যাপার কি।’ সন্ধ্যার পরও একই দাবি প্রচার করে ফেসবুকে।
গত বুধবার রাত নয়টার পর থেকে ফেসবুকে প্রচার হতে থাকে যে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রুদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুব্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।’
ফেসবুকে দাবি করা হয়, ‘গত দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি ইউনূস। ইউনূসের সময় ঘনিয়ে এসছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তাকে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে আজ। এর মধ্যে নির্বাচন দিয়ে পদত্যাগ করতে হবে ইউনূসকে।’ পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ দাবি ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে ফেসবুকে। সমজাতীয় দাবিতে কাজী মামুন ও মুফাসসিল ইসলাম নামের দুটি অ্যাকাউন্টের পোস্টের বরাতে বিষয়টি ভাইরালে রূপ নেয়। ফেসবুক থেকে বিষয়টি ছড়ায় ইউটিউব ও টিকটকেও।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার কিছু সময় পর যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেন তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘ইউনূসকে (প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস) ওয়াকার উজ জামান (সেনাপ্রধান জেনারেল জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান) সাতদিন সময় বেঁধে দিয়েছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। পক্ষান্তরে ইউনূস, ওয়াকার উজ জামানকে ২৪ ঘন্টার টাইম বেধে দিয়েছে পদত্যাগ করতে! সারজিস আলম সেনাপ্রধানের সঙ্গে বেয়াদবি করায় তাকে ধমকে বসিয়ে দিয়েছে আর্মির অফিসারদের কেউ একজন। বাকবিতন্ডা চলছে! এটাই যমুনার সর্বশেষ আপডেট।’
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর ও সেনাবাহিনীর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কাছাকাছি সময়ে যমুনার সামনের ভিডিও দাবি করে আরেকটি ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কিছু সেনাসদৃশ সদস্য যমুনায় প্রবেশ করছেন। জিওলোকেশন যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি যমুনার সামনে থেকেই ধারণ করা৷ তবে রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে ভিডিওতে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাঁদের ধারণা, ডিউটির (কর্তব্য) সময় বদল হওয়ায় একদল সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের যমুনায় প্রবেশের ফুটেজ হতে পারে এটি। এ ছাড়া সমন্বয়ক নাজমুলের লাইভ ভিডিও থেকেও স্পষ্ট যে যমুনার সামনে কোনো অস্বাভাবিক বা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবতারণা হয়নি।
কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টে যমুনার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িবহরের অবস্থানের দৃশ্য দাবি করে একটি ছবি প্রচার করা হয়। তবে যাচাই করে দেখা যায়, রাজবাড়ীতে গত বুধবরি দুর্গাম-পের পাঁচটি প্রতিমার মুখের অংশ আংশিক ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে অবস্থানের দৃশ্য সেটি।
শেখ হাসিনা দুবাই পালিয়ে গেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনও বিশ^াসযোগ্য তথ্য পাওয়া না গেলেও ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে গেছে। ফেসবুকে কেউ কেউ লিখছেন, হাসিনা আরব আমিরাতেও  স্থান পেলেন না। আশ্রয় নিয়েছেন বেলারুশে।  বাস্তবে কোনটিই সঠিক নয়। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেই দাবি করেছেন, মা শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারাও বলেছেন, শেখ হাসিনা দিল্লিীতেই আছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, নারায়নগঞ্জের বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের দুবাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।  পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেনের কাছে শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার কিছুই জানে না। কারণ দুবাইয়ে খোঁজ পেতে প্রবল অনুসন্ধান করা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ মেলেনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং অবশ্য ‘রিসেট’ বাটন টিপে অতীত মুছে ফেলা সংক্রান্ত ড. ইউনূসের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধ কিংবা তার ইতিহাস মুছে দেবার কথা বোঝাতে এমন মন্তব্য করেননি। বরং তিনি অতীতের মন্দ রাজনীতি মুছে দিতে বলেছেন। তবে এই ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হবার আগেই সোস্যাল মিডিয়ায় তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে। অনেকে ইউনূসের বক্তব্য নিয়ে তুলোধুনো করেছেন। তাপসী তাবাস্সুম উর্মি নামের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রধান উপদেষ্টার এহেন মন্তব্যে তুলোধুনো করেছেন। তারপর এই ম্যাজিস্ট্রেটকে চাকৃুরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ‘রিসেট’ মন্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চাপার কথাটি উলে¬খ করে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে এসে নতুনভাবে শুরু করার কথা বুঝিয়েছেন। তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি। কেউ কেউ বলছেন,  কেউ যখন কোনো ডিভাইসে রিসেট বোতাম চাপেন, তখন তিনি নতুন করে ডিভাইসটি চালু করতে সফটওয়াার সেট করেন। এতে হার্ডওয়ার পরিবর্তন হয় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের হার্ডওয়ার।
সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার ঘিরে কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
সারাদেশে গুজবের ডালপালা মেলে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার লগ্নে নতুন নতুন গুজবের সৃষ্টি হলে তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। ফলে গুজবের বিষয়টি নিয়ে এখন সকল মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে গুজবের চ্যালেঞ্জ সরকার কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাকে ঘিরে তীব্র অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মহলের দাবির মিছিল, পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের উত্তেজনা, সংখ্যালঘূ ইস্যু, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতে কটুক্তি, লেবাননে ইসরাইলি হামলা, আইএস এর ফ্লাগ নিয়ে মিছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও চিন্তিত। সাধারন মানুষ উদ্বিগ্ন। কি হতে হতে যাচ্ছে? অর্ন্তবর্তী সরকার কি ব্যর্থ হবেন? কোন পথে যাচ্ছে দেশ?