শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হিজবুল্লাহকে যেভাবে বোকা বানিয়েছিল ইসরায়েল

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:৪৭ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

ফিলিস্তিনের গাজার পাশাপাশি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে আসছিল হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল।

সেপ্টেম্বরে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সদস্যদের কাছে থাকা পেজারে (তারহীন যোগাযোগযন্ত্র) বিস্ফোরণ ঘটায় ইসরায়েল। এতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়। আহত হয় প্রায় তিন হাজার মানুষ। প্রচলিত যুদ্ধের বাইরে এ ধরনের হামলার ঘটনায় হিজবুল্লাহ রীতিমতো ধরাশায়ী হয়ে যায়। এরপর তাদের প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহকেও হামলা চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েল। এতে বিধ্বস্ত হয়ে যায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
কিন্তু পেজার ইস্যুতে কীভাবে হিজবুল্লাহকে বোকা বানিয়েছিল ইসরায়েল?

এ বিষয়ে বুধবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ব্যবহার না করা হিজবুল্লাহর সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেজার বিক্রির জন্য প্রথমে ভুয়া অনলাইন স্টোর ও পেজ তৈরি করা হয়েছিল। এসব পেজ থেকে নিয়মিত পোস্টও দেওয়া হতো। হিজবুল্লাহকে ফাঁদে ফেলতে এক বছর ধরে এই কার্যক্রম চালায় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর বিস্ফোরিত পেজারগুলোর মডেল ছিল এআর-৯২৪। এগুলো তৈরি করেছিল তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে গোল্ড অ্যাপোলো জানিয়েছে- হামলায় ব্যবহৃত পেজারগুলো তারা তৈরি করেনি। এগুলো হাঙ্গেরির বুদাপেস্টভিত্তিক একটি কোম্পানি তৈরি করেছে। অ্যাপোলো গোল্ডের লাইসেন্স ব্যবহারের অনুমতি আছে কোম্পানিটির।

গোল্ড অ্যাপোলোর চেয়ারম্যান হু চিং-কুয়াং পেজার হামলার একদিন পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন- প্রায় তিন বছর আগে তার প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মচারী তেরেসা উ এবং তার ‘বস’ টম একটি লাইসেন্স চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তেরেসা উ-এর ব্যাপারে তেমন বেশি তথ্য তার জানা নেই। তবে এরপরও তিনি গোল্ড অ্যাপোলো ব্র্যান্ডের অধীনে তাদের নিজস্ব পণ্য ডিজাইন করার এবং ব্যাপকভাবে বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

চেয়ারম্যান জানান, তিনি যখন এআর-৯২৪ এর মডেল দেখেছিলেন সেটি তার একটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু তারপরও তার কোম্পানির ওয়েবসাইটে পণ্যটির ছবি এবং একটি বিবরণ যুক্ত করেছিলেন। বিষয়টি হিজবুল্লাহকে দৃশ্যমানতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা উভয়ই দিতে সহায়তা করেছিল। তবে তার ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি এআর-৯২৪ কেনার কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

রয়টার্স তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এআর-৯২৪ এবং এর ব্যাটারির ছবিগুলো apollosystemshk.com-এ আপলোড করা হয়েছিল। ওই ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, তাদের কাছে গোল্ড অ্যাপোলোর পণ্য বিতরণের লাইসেন্স রয়েছে। ওয়েবসাইটটি অ্যাপোলো সিস্টেমস এইচকে নামে একটি কোম্পানির জন্য হংকংয়ের একটি ঠিকানা দিয়েছে। ঠিকানায় বা হংকং করপোরেট রেকর্ডে এই নামের কোনও কোম্পানি নেই।

apollosystemshk.com সাইটে পেজারের জন্য এলআই-বিটি৭৮৩ ব্যাটারির অসামান্য কর্মক্ষমতার ব্যাপারে ব্যাপক গুণকীর্তণ করা হয়েছিল। তাদের দাবি করা হয়, এলআই-বিটি৭৮৩ ব্যাটারি দিয়ে পুরনো প্রজন্মের পেজারগুলো চালানো যাবে। এটি এক চার্জে ৮৫ দিন পর্যন্ত চলতে পারে এবং ইউএসবি কেবলের মাধ্যমে চার্জ দেওয়া যেতে পারে। ব্যাটারির বিষয়ে ওয়েবসাইট এবং ইউটিউবে একটি ৯০ সেকেন্ডের প্রচারমূলক ভিডিও আপলোড করা হয়েছিল।

২০২৩ সালের শেষের দিকে দুটি ব্যাটারি স্টোর অনলাইনে এসেছিল। তাদের ক্যাটালগে এলআই-বিটি৭৮৩ ব্যাটারি নামে নতুন ট্যাব খোলা হয়। ব্যাটারির জন্য নিবেদিত দুটি অনলাইন ফোরাম চালু করা হয়। তাতে তথাকথিত ব্যবহারকারীরা ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। তবে এসব ব্যবহারকারীদের পরিচয় জানা যায়নি।

সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং দুই পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, ওয়েবসাইট, অনলাইন স্টোর এবং ফোরামের আলোচনা ছিল প্রতারণামূলক। লেবাননে পেজার বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে ওয়েবসাইটগুলো উধাও হয়ে গেছে।

পেজারগুলো কিনতে আক্রমণাত্মক বিক্রয় কৌশল ব্যবহার করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। হিজবুল্লাহকে তুষ্ট করতে এসব পেজারের দাম একেবারেই কমিয়ে ধরা হয়েছিল।

বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত এক ব্যক্তি জানান, বিক্রয়কর্মী পেজারগুলোর জন্য খুব সস্তা দর প্রস্তাব করেছিলেন। সূত্র: রয়টার্স