সাকিব অধ্যায় কি শেষের পথে?
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৭:০১ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২৪ রোববার
বিশ্বের অন্যতম সেরা বাঁহাতি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটে আর ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেন না। রাজনীতিতে জড়িয়েই সব হারালেন সাকিব, কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন সাকিব আল হাসান। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চুপ থাকার ফলে সমালোচিত হয়েছেন। এবার সেটার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন দেশবাসীর কাছে।
৯ অক্টোবর নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাকিব। জানিয়েছেন, নিজের ঘরের মাঠে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চান। আর সেই স্বপ্ন পূরণে পাশে চাইলেন দেশবাসীকে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসটি সাকিব বলেছেন, আসসালামু আলাইকুম, আমার দেশের প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা। আমার প্রতি আপনাদের দোয়া ও ভালবাসা আমাকে আজকের এই সাকিব আল হাসান হিসেবে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত করেছে। শুরুতেই আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সে সকল আত্মত্যাগকারী ছাত্রদের, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন। তাদের প্রতি এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা।
তিনি আরও বলেছেন, যদিও স্বজন হারা একটি পরিবারের ত্যাগকে কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ করা সম্ভব না। সন্তান হারানো কিংবা ভাই হারানোর বেদনা কোন কিছুতেই পূরণযোগ্য নয়। এই সংকটকালীন সময়টাতে আমার সরব উপস্থিতি না থাকায় আপনারা যারা ব্যথিত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন তাদের অনুভূতির জায়গাটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের প্রথম টেস্টের দলে সাকিবকে রেখেছে বিসিবি। সাকিবও দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত আসার পর থেমে গেছেন। দেশে ‘নিরাপত্তাঝুঁকি আছে’ উল্লেখ করে সেখান থেকে দেশে আসবেন না বলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন সাকিব।
গত কয়েক দিন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সাকিবের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছেন, দেয়াললিখন লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে। সাকিবের বিরুদ্ধে এসব হওয়ার কারণ, তিনি শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময় ‘নীরব’ ছিলেন। তবে এই নীরব থাকার জন্য এ মাসের শুরুর দিকে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করাসহ জনমনের ক্ষোভ নিরসনে তিনি ফেসবুক পোস্ট দিলেও সাম্প্রতিক প্রতিবাদে প্রতীয়মান হয়েছে যে তা যথেষ্ট ছিল না। যারা প্রতিবাদ করছে তাদেরও তা করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে।’
নিজেও চেয়েছেন সাকিবের মতো একজন ক্রিকেটার দেশের মাটিতে অবসর নিক জানিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেছেন, পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, ‘সাউথ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের মধ্যকার সিরিজে কোনপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতেই আপাতত দেশে খেলতে আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে বিসিবিকে পরামর্শ দিতে হয়েছে। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার আশু ব্যবস্থা হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কোনো অভিযোগ থাকলে আইনি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে সমাধান খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন আসিফ মাহমুদ।
এদিকে চরম নাটকীয়তার পর বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন ফিল সিমন্স। শনিবার মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাকিবকে নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি সিমন্স। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কে নেই, সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করিনা, এটা আমার কাছে কোনো বড় ব্যাপার নয়। যারা আছে তাদের নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি।’
বাঁহাতি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের অভাব পূরণ করতে হলে একইসাথে একজন জেনুইন বোলার ও ব্যাটারের দরকার। এ বিষয়ে ফিল সিমন্স বলেছেন, ‘এরকম নয়। যারা অ্যাভেইলেবল আছে তাদের নিয়েই আমরা ফোকাস করছি। সেভাবেই পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। প্রত্যেকে মাঠের ক্রিকেটে মনোযোগী হবে এটাই প্রত্যাশা।’
সাকিবকে নিয়ে এবার নতুন নাটকের জন্ম দিয়েছে ভক্তরা। সাকিবকে বিদায়ী টেস্ট খেলাতে ও দেশে ফেরাতে মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন সাকিবিয়ানরা। সাকিবকে বিসিবি খেলতে দিচ্ছে না এমন অভিযোগ এনে আইসিসির কাছে ই-মেইলেও নালিশ জানাচ্ছে তারা।
তাদের দাবি, সাকিবকে জোর করে দল থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে তাকে দেশে শেষ টেস্ট খেলতে দেওয়া হচ্ছে না, রাজনীতির কারণে বিসিবিও সাকিবকে সুযোগ দিচ্ছে না।
এসব অভিযোগ আইসিসিকে ই-মেইলেও জানাচ্ছে তারা। সাকিব ভক্তদের বিশ্বাস, আইসিসির কাছে ১০-১২ হাজার ইমেইল পাঠানো গেলে তা অবশ্যই আইসিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সাকিবিয়ানদের একটা অংশ আবার তাদের প্রিয় খেলোয়াড়কে দেশে ফেরাতে লং মার্চ করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
সাকিবকে নিয়ে বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দিনের বেলা বেশ নাটক হয়েছে। তিনি দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে দুবাই আসেন ট্রানজিটের জন্য। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাকে সেখানে অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সাকিব নিজেই জানান, তার দেশের মাটিতে টেস্টকে বিদায় জানানো হচ্ছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে সরকার তাকে দেশে ফিরতে বারণ করেছে।
সাকিবের বিষয়ে ১৮ অক্টোবর রাতে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে সাকিব আল হাসানের দেশে আসা নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সাকিব আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। আমি বলেছি, উপদেষ্টা আসিফের সঙ্গে কথা বলতে যেহেতু এটি আমার বিষয় নয়।'
আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, 'সাকিবের মতো ক্রিকেটার বাংলাদেশের ইতিহাসে আর আসেনি। সাকিব বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হতে পারত। কিন্তু যখন আন্দোলন চলছে, মানুষ মরছে, ঘরে ঘরে কান্না, ক্ষোভ-কষ্ট—সাকিব তখন পোস্ট দিলো যে সে কোথাও আনন্দ করছে। এটা কি সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে?'।
বিতর্কে না জড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাকিবের প্রশংসা করলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্স।
কিংবদন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, বাংলাদেশের জন্য সাকিবকে তেমনই মনে করেন প্রিন্স, ‘‘সাকিব বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার অনেকটা জ্যাক ক্যালিসের মতো যখন নিজের সময়ে সে আমাদের হয়ে খেলত। সাকিবের দলে থাকা শুধু দলের ভারসাম্যই তৈরি করে না, ওর সতীর্থরাও উদ্দীপ্ত হয় এমনিতে। ও না থাকায় আপনাকে সংশয়ে থাকতে হবে বাঁহাতি স্পিনার খেলাবেন নাকি ব্যাটার।’’
সাকিবের ক্যারিয়ারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে দীর্ঘদিন নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। খেলেছেন ৭০টি টেস্ট, ৫ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৪ হাজার ৬০০, বল হাতে নিয়েছেন ২৪২টি উইকেট।
আড়ইশ'র কাছাকাছি ওয়ানডেতে সাড়ে সাত হাজারের বেশি রান আর ৩ শতাধিক উইকেট আছে সাকিবের। টি-টোয়েন্টিতে কিছুটা মলিন হলেও, আড়াই হাজার রান আর ১৪৯টি উইকেট আছে তার।
তবে চলতি বছর ব্যাটে-বলে একেবারেই মলিন ছিলেন সাকিব। এ বছর কোনো ওয়ানডে খেলেননি। টেস্ট খেলেছেন ৪টি। তাতে কোন সেঞ্চুরি এমনকি ফিফটিরও দেখা নেই। বল হাতেও ছুঁতে পারেননি ফাইফারের মাইল।
টি-টোয়েন্টিতেও ধূসর তার চলতি বছরের হিসাবনিকাশ। ১২ ম্যাচে ১৬৯ রান আর মাত্র ৯টা উইকেট তার ঝুলিতে। গড়, স্ট্রাইক রেইট কোনোটাই তার পক্ষে কথা বলছে না। পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সম্প্রতি শরীরটাও কথা বলছে না তার পক্ষে। ফলে কিছুটা মলিন মুখেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন সাকিব।